রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর অপসারণ নিয়ে গরম হয়ে ওঠা রাজনৈতিক মাঠ আপাতত কিছুটা ঠান্ডা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের মনোনীত এই রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে দেশে যে নতুন রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা দূর হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নবগঠিত নাগরিক কমিটির এ-সংক্রান্ত দাবিকে কেন্দ্র করে দেশে দ্বিধাবিভক্তির যে ঢেউ উঠেছিল, তা-ও স্তিমিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে শিগগির পদচ্যুত করার কোনো সম্ভাবনা নেই।
যে প্রশ্নটি গুরুতর হয়ে দেখা গিয়েছিল, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন পদত্যাগ করলে বা তাঁকে পদচ্যুত করা হলে দেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হবে কি না। কেউ কেউ বলছেন তাতে তেমন কোনো সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হবে না। জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হলে এটা অসম্ভব কোনো বিষয় নয়। যাঁরা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণ চান তাঁদের কথা হলো, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ও তৎপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট গণ-অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় মো. সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণ বিপ্লবের অংশ হিসেবে সিদ্ধ। অন্যদিকে সচেতন ব্যক্তিদের বক্তব্য হলো, যেহেতু আগস্ট বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সের ভিত্তিতে বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে এবং শপথ নেওয়ার সময় প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টারা ‘সংবিধান সমুন্নত’ রাখার অঙ্গীকার করেছেন, তাই সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটে এমন কোনো পদক্ষেপ তাঁরা নিতে পারেন না, নিলে শপথ ভঙ্গ হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হলে তা পূরণের যে সাংবিধানিক বিধান রয়েছে, তা অনুসরণ করা দুরূহ হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে দেখা দেবে সাংবিধানিক সংকট, যা দেশকে অসাংবিধানিক পথে ঠেলে দিতে পারে। যার ফলে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে সৃষ্টি হতে পারে অন্তরায়।
আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, অপসারণ বা অন্য কোনোভাবে শূন্যতা সৃষ্টি হলে তা পূরণের বিষয়ে রীতি-পদ্ধতি সুস্পষ্টভাবেই বর্ণনা করা আছে। সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ থেকে ৫৪ অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধানাবলি এবং তাঁকে অপসারণ বা তাঁর পদত্যাগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে স্পষ্ট করেই উল্লেখ আছে। ৫৩ অনুচ্ছেদের (১) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইতে পারিবে; ইহার জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে কথিত অসামর্থ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের নিকট প্রদান করিতে হইবে।’ ৫৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ক্ষেত্রমত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করিবেন।’
আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতির পদটি আলংকারিক হলেও এ পদে নির্বাচন ও নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের প্রক্রিয়াটি সহজ নয়, বরং জটিল। কেননা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও অপসারণ কোনো একজন বালককে স্কুলে ভর্তি কিংবা স্কুল থেকে টিসি দিয়ে বের করে দেওয়ার মতো নয়। যাঁরা এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ জরুরি মনে করে কথা বলছেন, তাঁরা হয়তো খেয়াল করছেন না, স্বপদে ইস্তফা দেওয়া বা অপসারিত হওয়ার মতো কোনো কাজ সাহাবুদ্দিন এখন পর্যন্ত করেননি। তা ছাড়া যেহেতু দেশে এখন সংসদ নেই, স্পিকারও স্বপদে বহাল নেই, তাই রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের বিষয়টি যেমন সহজ নয়, তেমনি তিনি কার কাছে পদত্যাগপত্র পাঠাবেন, তা-ও সংবিধানে বলা নেই।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার আড়াই মাসের মাথায় রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের জোরালো আওয়াজ ওঠে মূলত রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের একটি মন্তব্যের কারণে। দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী তাঁর সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন নাকি তাঁকে বলেছেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনো দালিলিক প্রমাণ তাঁর কাছে নেই।’ এখানে লক্ষণীয়, রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন শেখ হাসিনা পদত্যাগের দালিলিক কোনো প্রমাণ তাঁর কাছে নেই বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি’ বলেননি। এই মৃত ইস্যুটিকে পুনরুজ্জীবিত করে দেশে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিতর্ক তৈরি করা কোনোমতেই সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। তবে অভিজ্ঞ সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁর একান্ত আলাপচারিতাকে নিবন্ধে উল্লেখ করা সমীচীন হয়েছে কি না,
এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। কেননা, কোনো ব্যক্তি একান্ত আলাপচারিতা বা কথোপকথনের নানা বিষয়ে কথা বলতেই পারেন। তবে সেই ব্যক্তির পূর্বানুমতি না নিয়ে তা প্রকাশ করা সাংবাদিকতার রীতিবিরুদ্ধ। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন মতিউর রহমান চৌধুরীকে ওই কথোপকথনের বিষয়বস্তু প্রকাশের অনুমতি দিয়েছিলেন কি না আমার জানা নেই।
মূলত মতিউর রহমান চৌধুরীর ওই তথ্য প্রকাশের পরই রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়টি জোরেশোরে আলোচিত হতে থাকে। তারই সূত্র ধরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি দাবি তোলে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের দুইজন উপদেষ্টা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। প্রচারিত, তাঁরা প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করেছিলেন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে। কিন্তু তিনি বিনয়ের সঙ্গে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। জানা যায়, তিনি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো বিষয়ে নিজেকে জড়াতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। সেখান থেকে অনেকটা হতোদ্যম হয়ে ফিরে আসার পর উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না।’