ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তার বয়স তিন মাসের কাছাকাছি। কোনো সরকারের সাফল্য–ব্যর্থতা বিচারে এটি যথেষ্ট সময় নয়। তারপরও প্রশ্ন উঠেছে, সরকার জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষার কতটা পূরণ করতে পারছে? শুরুতে তাদের মধ্যে যে আশা জেগেছিল, সেটা কতটা ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে।
অস্বীকার করা যাবে না, অন্তর্বর্তী সরকার যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়, তখন দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর তিন দিন কোনো সরকার ছিল না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে জনপ্রশাসন, শিক্ষাঙ্গন থেকে পরিবহন, ব্যবসা–বাণিজ্য থেকে শিল্পকারখানা—সর্বত্র বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য চলছিল। সেই অবস্থা থেকে দেশকে স্বাভাবিক ও সুস্থ পরিবেশে নিয়ে আসার কাজটি কঠিন এবং এ জন্য প্রয়োজন ছিল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি দক্ষ ও মেধাবী টিম। সারা বিশ্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু সরকার তো একজনকে দিয়ে চলে না; তাঁর সহযোগীদেরও সমানতালে চলার সামর্থ্য ও সদিচ্ছা থাকতে হয়।
বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারগুলোর মন্ত্রিসভা সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০ জন নিয়ে গঠিত হতো। তদুপরি থাকত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক উপদেষ্টামণ্ডলী। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে আছেন মাত্র ২১ জন। এর বাইরে বিশেষ সহকারী আছেন দুজন। সে ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার টিম হওয়ার কথা আরও দক্ষ, অভিজ্ঞ ও উদ্যমী। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি উপদেষ্টা পরিষদের অনেকেরই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতার অভাব আছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম চাওয়া হচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক ধারা থেকে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় নিয়ে আসা। একই সঙ্গে বৃহত্তর জনগণের যে দৈনন্দিন সমস্যা, তারও সমাধান করতে হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমেই হোঁচট খেল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রথমে যাঁকে দেওয়া হয়েছিল, তিনি সামরিক বাহিনী থেকে এলেও বেসামরিক প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি কঠিন সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে যথাসাধ্য চেষ্টাও করেছিলেন। সম্ভবত রাজনৈতিক বিষয়ে একটি মন্তব্যের কারণে তাঁকে সেখান থেকে অন্য মন্ত্রণালয়ে যেতে হলো।
এরপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে যাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনিও সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তাঁর বেসামরিক প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে তিনি কতটা সাফল্য দেখাতে পেরেছেন, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে সরকার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত করে। সেনা, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। সেনাসদস্যদের বিচারিক ক্ষমতাও দেওয়া হয়। কিন্তু জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বিগ্ন জনগণ আশ্বস্ত হতে পারছে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজটি সার্বক্ষণিক হওয়া সত্ত্বেও একই উপদেষ্টাকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া কতটা সমীচীন হয়েছে, সেটাও দেখার বিষয়। একজন কৃষি অর্থনীতিবিদ আলাপ প্রসঙ্গে বললেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সবচেয়ে অবহেলিত কৃষি খাত। এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শস্য কম হয়েছে, আগামী বছর আরও কম হবে কৃষক প্রয়োজনীয় সহায়তা না পেলে।
বিগত সরকারের আমলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের মাত্রা ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর অর্থনীতি, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে কিছু শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ায় শৃঙ্খলা ফিরে আসতে শুরু করেছে। অর্থ উপদেষ্টা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু অর্থনীতির মূল যে চালিকা শক্তি—বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারের আস্থার সম্পর্ক গড়ে না ওঠা এখনো উদ্বেগের বিষয়। উপদেষ্টা পরিষদে ব্যবসায়ীদের একজন প্রতিনিধি থাকলে সরকারের সঙ্গে তঁাদের কর্মসম্পর্কটি আরও ভালো হতো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাও নিজের সক্ষমতা দেখাতে পেরেছেন। নানা সমস্যা সত্ত্বেও আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় বেশ সক্রিয়। সংস্কৃতি ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিরা দায়িত্ব পেয়েছেন। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগও প্রশংসার দাবিদার। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মেও গতি আছে। উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্র আন্দোলন থেকে আসা দুই তরুণ সদস্যের তৎপরতাও দৃশ্যমান।