কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া। তিন বছর ধরে এ দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সিন্ডিকেট এবং সমাধান নিয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে।
জিনিসপত্রের দাম এখনো না কমার কারণ কী?
হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া : একেবারেই যে কমেনি, সেটা বলার সুযোগ নেই। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুযোগ নিয়েছে ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণি। যারা আসলে সুযোগে অসাধু হয়ে ওঠে। সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। বিগত সরকারের আমলে তারা সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। বিগত সরকার সেই সময় সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেনি। বর্তমান সরকার আসার পর চেষ্টা করছে বাজার নিয়ন্ত্রণের। সাধারণ ভোক্তারা যাতে ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারে। বর্তমানে বাজার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না এলেও দুই দিন আগে দেখা গেছে, সবজির দাম আগের চেয়ে কমেছে। মুরগির দাম বাড়লেও ডিমের দাম কমেছে। সরকার কিছু পণ্য আমদানি করায় দাম আরও কমে আসবে বলে ক্যাবের পক্ষ থেকে মনে করছি।
ট্রেনের মাধ্যমে কৃষিপণ্য আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে কোনো উপকার হবে কি?
হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া : সরকার এটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা কিন্তু অনেক আগে থেকে এ কথা বলে আসছি। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রেনে কৃষিপণ্য আনা গেলে যাতায়াত খরচ অনেক কমে যাবে। ফলে পণ্যের দামও কমে যাবে।
আমরা জানি, জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতির মূল কারণ সিন্ডিকেট। বর্তমান সরকার কেন এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না?
সিন্ডিকেট তো এখনো বাজারে সক্রিয়। দেশে অধিকাংশ পণ্যের জোগানে অভাব নেই। পর্যাপ্ত পণ্য বাজারে আছে। কিন্তু দাম সে তুলনায় কমছে না। এটার মূল কারণ হলো ‘সিন্ডিকেট’। এ জন্য বাজার তদারকির জন্য শুধু খুচরা বাজারে গেলে হবে না, পাইকারি বাজারে যেতে হবে। মানে, যারা পণ্যের দাম বাড়ায়, তাদের কাছে যেতে হবে। কিন্তু ভোক্তা অধিকার বাজারে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে পণ্যের দাম কমে যায়। কিন্তু বাজার থেকে চলে গেলে পণ্যের দাম আবার বাড়ানো হয়। এটাও সিন্ডিকেটের কারণে হয়। এই সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য ক্যাবের পক্ষ থেকে পরামর্শ হলো, বাজার তদারকির জন্য ভোক্তা অধিকার ছাড়া কোনো মন্ত্রণালয় সেখানে যায় না। তাই সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না। সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষমতা একমাত্র সরকারের হাতে। ভোক্তা অধিকারের পক্ষে এটা ভাঙা সম্ভব নয়।
সরকার টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলেছে। সেটাকে আমরা স্বাগত জানাই। এতে পণ্যের দাম কমে যেতে পারে। তবে সিন্ডিকেট ভাঙা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। কারণ, ব্যবসায়ীরা একেক সময় একেক পণ্যের দাম বাড়ায়। দেখা যায়, কখনো পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়, কখনো ডিম বা ডালের দাম বাড়ানো হয়; কখনো আলু, কখনো মাছসহ নানা ক্ষেত্রে তারা এই অপকর্মগুলো করে থাকে। নানা সময় বিভিন্ন পণ্যের ওপর সিন্ডিকেট থাবা বসায়।
সম্প্রতি কোল্ডস্টোরেজ থেকে লাখ লাখ ডিম উদ্ধার করা হয়। কোল্ডস্টোরেজে আলু থাকার কথা। কিন্তু সেখানে ডিম পাওয়া গেছে। এই যে ঘটনাগুলো, এসব নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সিন্ডিকেট ভাঙা অসম্ভব। সিন্ডিকেটের ঘটনা আরেকটা ক্ষেত্রে ঘটে; যেমন কেউ যদি তার পণ্য বিক্রি না করে, সেটাও তো একধরনের সিন্ডিকেট।
আমরা মনে করি, সরকারের হাত অনেক লম্বা। তারা যদি চেষ্টা করে, তাহলে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর সব ব্যবসায়ীর কথা বলতে পারব না। তবে কিছু ব্যবসায়ী এখনো সিন্ডিকেট করে তাদের পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।
নিত্যপণ্যের বিপণনব্যবস্থায় যে অনিয়ম আছে, সেটাকে সমন্বিতভাবে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে কী করা যেতে পারে?
হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া : এটা অবশ্যই সম্মিলিতভাবে করতে হবে। যেসব মন্ত্রণালয় এসবের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। যেমন কৃষি মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বিপণন অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়—সবাই যদি সমন্বিতভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, তাহলে বাজার সিন্ডিকেট কার্যকর থাকবে না।
সরকার ডিম আমদানি করছে। তারপরেও কীভাবে বাজার থেকে ডিম উধাও হয়ে যায়? আবার সরকার যখন কোনো পণ্য আমদানির কথা ঘোষণা করে, তখন ব্যবসায়ীরা বলে, তারা এ পণ্য কম দামে বিক্রি করতে পারবে। বড় ব্যবসায়ীরা খুচরা ব্যবসায়ীদের ওপর একধরনের মানসিক নিপীড়ন চালায়। বড় ব্যবসায়ীরা বাজার এমনভাবে সিস্টেম করে রেখেছে, তাদের কাছ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীদের পণ্য ক্রয় করা ছাড়া উপায় থাকে না। সরকারকে এই সিস্টেমও ভেঙে দিতে হবে। এ জায়গায় মজুরি কমিশনকেও সক্রিয় করার দরকার আছে। কেউ বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করবে, তাদেরকে এলসি খোলার জন্য সহযোগিতা করতে হবে, তাহলে সিন্ডিকেট থাকবে না। সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য তো প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এখানে কোনোভাবেই পণ্যের
দামের প্রতিযোগিতা হয় না। আমাদের দেশে বিশেষ করে কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে এটা হয় না। এখানে এমন একটা মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি আছে, তাদের ব্যবসা করার জন্য লাইসেন্স লাগে না এবং ভ্যাটও দিতে হয় না। আবার ব্যবসা করার জন্য তেমন পুঁজিরও দরকার পড়ে না। তারা শুধু মোবাইল দিয়ে যোগাযোগ করে একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। এগুলোর ক্ষেত্রেও সরকারের বিশেষ তদারকির দরকার আছে।