সম্মিলিত চেষ্টা ছাড়া পরিত্রাণ নেই

যুগান্তর ড. হাসনান আহমেদ প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৫২

‘নীল দর্পণ’ নাটকে পড়েছিলাম ‘কাঙালের কথা বাসি হলে ফলে’। বাসি হয়ে ফললে লাভ তেমন কিছুই হয় না। দেরি হলেও পরে বোঝা যায় কাজটা করা উচিত ছিল। এতে অনুশোচনা জাগে। তাতে কী লাভ! সময়ের করণীয় সময়ে বোঝাটা জরুরি। এজন্য বিশেষ করে দেশ-চালকদের দূরদর্শী হওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন। লালন গেয়েছিলেন, ‘অসময়ে কৃষি করে মিছামিছি খেটে মরে, গাছ যদিও হয় বীজের জোরে, ফল ধরে না, তাতে ফল...।’ পত্রিকার পাতায় লিখতে গিয়ে কত বিষয়ে কত কথাই না বিভিন্ন সময় লিখি, ক’জনইবা গুরুত্ব দেয়! তাই মাঝেমধ্যে নিবন্ধ-রোমন্থন প্রয়োজন হয়।


রাষ্ট্রপতি পদ, রাষ্ট্রের প্রধানের বড় সম্মানের পদ; সঙ্গে দেশের মানমর্যাদা জড়িত। তিনি অতীতের বলা কথার সঙ্গে বর্তমান বলা কথার মিল রাখতে না পেরে বিপদে পড়ে গেছেন। এটি অনেকের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত তো বটেই, রাষ্ট্রপতি পদের জন্যও কি শোভনীয়? ভাবতে খারাপ লাগে, আমাদের দেশের ‘মহান রাজনীতিকরা’ সব সম্মানিত পদকে তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে এত ঠুঁটো জগন্নাথ ও বালখিল্য বানিয়ে ফেলছেন কেন? আসলেই বিষয়টি চিন্তার উদ্রেক করে। আমরা ক্রমেই পদের মর্যাদাকে ছোট ও তুচ্ছ বানিয়ে ফেলছি। নাকি আমরা দেশীয় সব সরকারি ও রাজনৈতিক পদ অপাত্রে সমর্পণ করছি? মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, বড় কর্তা-কার কথার ওপর আমরা ভরসা রাখতে পারি বলুন? কথার সঙ্গে কাজের মিল পাওয়া দুষ্কর। দেশের প্রতিটি পর্যায়ে সাধারণ নেতা-টেতা ও সোশ্যাল টাউটদের মধ্যে এ রোগের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। লিখে রাখা কথাও উলটিয়ে ফেলা হয়। দেশের মর্যাদার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়। একবার লিখেছিলাম, কে কোন দল করে তার ভিত্তিতে মানুষের ভালো-মন্দ বিচার নয়, যার মধ্যে মনুষ্যত্বের গুণ যত বেশি, সে তত ভালো মানুষ। মানুষের ভালো-মন্দ বিচারের মাপকাঠিও আমাদের সমাজে পরিবর্তন করে ফেলেছি। সমাজকেও বিভক্ত করে ফেলেছি। সবই অধঃপতনের পথ।


দুর্নীতি দমনের কথা অনেকবার লিখেছি। অসুবিধা হচ্ছে, দুর্নীতি বলতে আমরা অনেক রকম দুর্নীতির মধ্যে মাত্র এক ধরনের দুর্নীতি অর্থাৎ ‘আর্থিক দুর্নীতি’কে বুঝি। অথচ সব ধরনের দুর্নীতিতে দেশ সয়লাব, যা আমাদের ঘিরে ধরেছে। এসবের বেশি রকমফের তৈরিতে অধুনা পতিত সরকারের অবদানই বেশি। অন্যদের অবদানও নেহায়েত কম নয়। ভবিষ্যৎ আগন্তুকদের জন্য এসব ট্রেনিং, পথ ও পদ্ধতি নিশ্চয়ই ধন্বন্তরি পাথেয় হিসাবে কাজে লাগবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে এ নিয়েই আমরা এদেশে আছি। ‘ভ্যালারে নন্দ বেঁচে থাক চিরকাল’। এতে ভুগছে একমাত্র দেশ ও দেশের মানুষ।



অন্তর্বর্তী সরকারের আগমনে টাকা পাচার, লুটপাট কমলেও ঘুস-বাণিজ্যের রেট হয়তো বেড়ে থাকতে পারে। এ নিয়ে তারা কতটুকু উদ্বিগ্ন, জানা নেই। আরও কিছুদিন গেলে পরিষ্কার বোঝা যাবে। ‘স্বভাব যায় ম’লে আর ইল্লত যায় ধুলে’। এ কথাও তো কতবার, কত রকমের উদাহরণ দিয়ে, কখনো টিপ্পনী কেটেও বলেছি। অঙ্গচ্ছেদ না করা পর্যন্ত কি পচন রোধ হয়? যদিও আমরা সে চেষ্টা করি। ‘বাকির আশায় নগদ পাওনা, কে ছাড়ে এ ভুবনে’-লালনের এ গান গেয়েও অনেকবার শুনিয়েছি। বোঝাতে চেয়েছি, এদেশের নব্বই ভাগ মানুষ মুসলমান হলেও তাদের মধ্যে সততা, ইমানি বৈশিষ্ট্য বিদায় নিয়ে তাদের অধিকাংশ ভোগবাদে নিমজ্জিত এবং ধর্মের ভবিষ্যৎ প্রাপ্তিকে বিসর্জন দিয়ে বর্তমান সাতপুরুষ বসে খাওয়ার স্বপ্নে অবৈধভাবে সম্পদ মজুতের নেশায় মত্ত। অনেক দেশের অমুসলমানরা তা করে না।


জনগোষ্ঠীর মধ্যে মনুষ্যত্ব সঞ্চারক শিক্ষার ঘাটতি হয়ে গেলে এসব নেশা থেকে সহজে বেরিয়ে আসা যায় না, যার জন্য আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ, মনুষ্যত্ব সঞ্চারক শিক্ষার প্রবর্তন এবং শর্ষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভূত আগে তাড়াতে হবে। এর অর্থ পরিচালকদের ‘আগে নিজের স্বভাব সুন্দর করো, তারপর...’ নীতি বাস্তবায়ন করো, হতে হবে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার জন্য সমমনা একদল লোক কই? রাজনৈতিক দলগুলোও এ নিয়ে ভাবে না। এসব বস্তাপচা সেকেলে কথা ভেবে উড়িয়ে দেয়। আসলে জনগোষ্ঠীর মানসিকতা ও চিন্তা-চেতনার আপাদমস্তক পচে গেছে। জনসম্পদ জনআপদে পরিণত হয়েছে। এসব নিয়ে কারও কোনো টুঁ শব্দও নেই। সেজন্যই গত লেখার শিরোনাম দিয়েছিলাম, ‘এখনো পথ বহুদূর যেতে হবে’। আমি নিশ্চিত, ডাক্তার দক্ষ হলে রোগের নিরাময় এখনো সম্ভব; জাতীয় এ ‘ক্যানসারের’ চতুর্থ ধাপ এখনো বাকি। কিন্তু দক্ষ ডাক্তার এদেশে কোথায়? সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন এবং অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক সদিচ্ছা ছাড়া দেশের এ নাভিশ্বাস দশা থেকে উত্তরণের অন্য কোনো পথ এ ক্ষুদ্র মাস্টার সাহেব দেখে না। তাই তো বলছিলাম, ‘কাঙালের কথা বাসি হলেই ফলে’। আমি তো দেখি, ১৪ দল বাদে অন্তর্বর্তী সরকার ও বাকি দলগুলোর সম্মিলিত ঐকান্তিক চেষ্টা ছাড়া এ অকূলপাথার থেকে পরিত্রাণের পথ অরণ্যে রোদন হতে বাধ্য। সে শুভবুদ্ধির উদয় কি রাজনৈতিক দলগুলোর সহজে হবে?


এ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ ওঠা শুরু হয়েছে। এর দুটি কারণ থাকতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ-পরিদপ্তরের লোকজন ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছে না; অর্থাৎ ভাবছে, ‘কদিন বাদেই তো এদের বিদায়; গোলেমালে কাটিয়ে দেব এ কটা দিন।’ বিভিন্ন কাজ দেখে আমার কাছে এমনটিই পরিস্ফুট হয়েছে। আরেকটি বিষয়, কয়েকজন উপদেষ্টার কর্মদক্ষতা। আমার পরামর্শ ছিল, নিয়মিত একসঙ্গে বসে অসুবিধাগুলো একে অন্যের সঙ্গে খোলামেলা শেয়ার করা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োগ করা। মানুষ নিয়ন্ত্রণ করা ও তাদের দিয়ে দায়িত্ব মতো কাজ করিয়ে নেওয়া অনেক কঠিন বিষয়; এখানে সবাই মাতব্বর। বিশেষ করে এদেশে, যেখানে কর্মকর্তাদের দায়িত্ববোধের ঘাটতি রয়েছে, নির্দিষ্ট রাজনীতিকদের লেজুড়বৃত্তি করা যাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, কর্তৃত্ববাদী প্রতিবেশী ও তাদের এদেশীয় দীক্ষাগুরুর প্রত্যক্ষ মদদ এবং বিভিন্ন বিভাগ দুর্নীতিতে দীর্ঘদিন ধরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। অন্তর্বর্তী সরকারকে ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে এসব প্রতিকূল পরিবেশ শক্ত হাতে মোকাবিলা করেই কাজ করে যেতে হবে। এজন্য শক্ত মেরুদণ্ডসম্পন্ন উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী উপদেষ্টা আরও কয়েকজন নিয়োগ দিতে হবে।


গুরুত্ব দেওয়ার বিষয় হলো : যে কারণে সেই স্বাধীনতার পরপরই ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়েছিল এবং অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে ২০২৪ সাল নাগাদ তার পূর্ণতা পেল, সেই ভিত্তিগুলো প্রয়োজনমতো সংস্কারের মাধ্যমে দুর্বল বা উচ্ছেদ করতে আমরা পারছি কিনা, তার ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে আবার এদেশে ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে কিনা সে বিষয়টি। এ জটিল অবস্থাকে সামাল দেওয়া ও নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন বলে মনে করি না। এ মুহূর্তে এদেশের সামনে আর কোনো বিকল্প দেখি না। প্রথম থেকেই আমি বলে আসছি, এটি এদেশের ছাত্র-জনতার বিপ্লব। এর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে দেড় যুগ আগে। এ সরকারের নাম ‘বিপ্লবী সরকার’ হওয়াই বাঞ্ছনীয়; এতে দেশের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনার অনেক সুবিধা আছে। আমার মতো অখ্যাত মাস্টার সাহেবের লেখাগুলো এতদিন ধরে নীতিনির্ধারকরা গুরুত্ব দিলে এবং বর্তমানে কিছু উপদেশ নিলে দেশ হয়তো উপকৃত হতো।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us