ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ‘ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন’ বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পর তাদের দিক থেকে কিছু প্রতিক্রিয়া স্বভাবতই রয়েছে। সেটা অবশ্য বিরাট কিছু নয়। একদা প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো তাদেরও আত্মগোপনে যেতে হয়েছে; সেটা হোক দেশে কিংবা বিদেশে। ‘চুক্তি’তে ভারতে পালাতে গিয়ে তাদের এক সাবেক নেতার সীমান্তে করুণ মৃত্যু ঘটে। ছাত্রলীগের অনেকেরই কালক্রমে দাপুটে আওয়ামী লীগ নেতায় পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াটি তো সবার জানা। ছাত্রলীগের জন্মও হয়েছিল আওয়ামী লীগের আগে।
সেই ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে তাই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ অবধি এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার যারা অংশীদার কিংবা প্রত্যক্ষদর্শী, তাদের সবার জন্য সংগঠনটির এ পরিণতি বেদনাদায়কও বটে। এ প্রজন্ম অবশ্য অপসৃয়মাণ।
২০০৮ সালের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগ নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের যে ভূমিকা ক্রমে জনগণের সামনে এসেছে, সত্যি বলতে সে প্রেক্ষাপটেই অন্তর্বর্তী সরকার নিষিদ্ধ করল সংগঠনটিকে। যে আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটল, তা মোকাবিলায় ছাত্রলীগকে দেশব্যাপী ভয়ানকভাবে ব্যবহারের দৃশ্যগুলোও এখনও তরতাজা। সরকার পতনের পর ‘অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির’ কিছু ঘটনায়ও তাদের ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি সচিবালয়ে ঢুকে অরাজকতা সৃষ্টির দায়ে গ্রেপ্তার ছাত্রদের একাংশ ‘ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত’ বলে জানিয়েছে পুলিশ।
প্রশ্ন অবশ্য উঠতে পারে, ছাত্রলীগের আদৌ কোনো ‘রাজনীতি’ ছিল কি? রাজনীতি যদি হয়ে থাকে যে কোনো উপায়ে অর্জিত রাষ্ট্রক্ষমতা আঁকড়ে থাকা, তাহলে বলতে হবে– আওয়ামী লীগের একটা রাজনীতি ছিল। আর সেটিকে প্রশ্নহীন আনুগত্যে মাঠেঘাটে বাস্তবায়নের চেষ্টা যদি হয় ‘ছাত্র রাজনীতি’, তাহলে বলতে হবে– ছাত্রলীগেরও একটা রাজনীতি ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তারা সেটা করার আইনগত অধিকার হারাল কেবল।
তবে নিষিদ্ধ করলেই তো কোনো সংগঠনের তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায় না। এ ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে রয়েছে ‘অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা’। যে আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটল, তাতে এমন একাধিক ছাত্র সংগঠনের জোরালো অংশগ্রহণের অভিযোগ এখন খোদ আওয়ামী লীগই করছে; যারা ছিল তাদের আমলে নিষিদ্ধ কিংবা প্রায় নিষিদ্ধ। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক তৎপরতা কিন্তু কখনোই কম দেখা যায়নি। তাতে আদতে লাভ যে হয়নি, সেটি এখন পরিষ্কার।
তাহলে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পরও কি এক সময় একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে? এ ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট অবশ্যই বড় বিবেচ্য।
আওয়ামী লীগ সরকারও পতনের আগে কিছু অভিযোগ তুলে জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছিল। আন্দোলনের একেবারে শেষ দিকে সরকার কেন এমন পদক্ষেপ নিয়েছিল, সেটা তখন বুঝতে কারও কষ্ট হয়নি। কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের দিকে চলে যাওয়া আন্দোলনটি আসলে ‘জামায়াত-শিবিরের’, এমন ট্যাগ দিয়ে কোনো ফায়দা অবশ্য হয়নি। এর দু’দিনের মধ্যেই সরকারের পতন ঘটে যায়। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে দ্রুত দেশত্যাগ করে ভারতে যেতে হয়।
তিনি ছাত্রলীগের ‘সাংগঠনিক নেত্রী’ বা ‘অভিভাবক’ বলেও পরিচিত ছিলেন। সে কারণে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে ব্যক্তিগতভাবেও বিব্রত হয়েছিলেন। একবার এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে তিনি অব্যাহতি দেন খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঁদাবাজির মতো ঘটনায়। সংগঠনটির কার্যক্রম স্থগিতের ঘটনাও ঘটেছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কমে আসেনি কোথাও। তাদের বিরুদ্ধে বিচারে মৃত্যুদণ্ডের ঘটনাও রয়েছে। সব শেষে তারা নজিরবিহীনভাবে ব্যবহৃত হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে। এ অবস্থায় সরকার পতনের পরপরই ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছিল অভ্যুত্থানকারী কোনো কোনো মহল থেকে। এ নিয়ে অবশ্য দ্বিমত রয়েছে খোদ আন্দোলনকারী ও এর সমর্থকদের মধ্যে। কারও দ্বিমত নিষিদ্ধকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে; কারও সিদ্ধান্তটি নিয়েই। এমনও বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না করে এর দ্বারা ব্যবহৃত ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা তো যুক্তিযুক্ত হলো না।