সংবিধান সংশোধন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে 'বাতিল' শব্দটিও এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। কেননা সংবিধানে এখন পর্যন্ত যে ১৭ বার সংশোধনী আনা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সংশোধনীগুলোই হয় সর্বোচ্চ আদালতে বাতিল হয়েছে, না হয় আদালতে বিচারাধীন কিংবা আদালতে বাতিল হওয়ার পরে সেটিও চ্যালেঞ্জড হয়েছে।
২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতি ফিরিয়ে আনাসহ আরও যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছিল, সেটিও আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এবং এই সংশোধনীটিও শেষ পর্যন্ত অবৈধ ঘোষণা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধান কেন এরকম সংশোধন ও বাতিলের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে? সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ঐকমত্য ছিল না বলে? যদি তাই হয়, তাহলে গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে সংবিধানে যে আমূল পরিবর্তন, এমনকি অনেকগুলো অনুচ্ছেদ পুনর্লিখনের কথা বলা হচ্ছে; অন্তর্বর্তী সরকারের 'প্রাথমিক নিয়োগকর্তা' হিসেবে স্বীকৃত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কেউ কেউ বর্তমান সংবিধানকে 'মুজিববাদী' এবং 'আওয়ামী লীগের সংবিধান' আখ্যা দিয়ে একে ছুঁড়ে ফেলার কথা বলছেন—তার ধারাবাহিকতায় যদি এবারও সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়, সেটিও কি ভবিষ্যতে টিকবে? নাকি সেই সংশোধনীও আদালতে চ্যালেঞ্জড হবে এবং বাতিল হয়ে যাবে? এই আশঙ্কা থেকেই কি নতুন করে সংবিধান লেখার কথা বলা হচ্ছে?
মুশকিল হলো, নতুন করে সংবিধান লেখার সাংবিধানিক এখতিয়ার বা ম্যান্ডেট অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। আবার পরবর্তী জাতীয় সংসদও নতুন করে সংবিধান লিখতে পারবে না। বরং দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সম্মতি থাকলে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা যাবে। কিন্তু সংবিধান নতুন করে লিখতে গেলে বা পুনর্লিখন করতে গেলে গণপরিষদ গঠন করতে হবে। সেজন্য নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন করে সেখানে নতুন করে সংবিধান লিখতে হবে। কিন্তু সেই পথে যাওয়ার মতো বাস্তবতা আছে কি না, বা গণপরিষদ গঠন করে সংবিধান পুনর্লিখন ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলা যাবে কি না—সেটা বিরাট প্রশ্ন। সেই তর্কে না গিয়ে বাংলাদেশের সাংবিধানিক যাত্রায় সংশোধন ও বাতিলের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোকপাত করা যাক।
সংবিধানে এ যাবত যে ১৭ বার সংশোধনী আনা হয়েছে, তার মধ্যে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, ত্রয়োদশ এবং সবশেষ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসম্বলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের রিভিউ বা পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছে তিনটি পক্ষ। সেই রিভিউয়ের ওপর শুনানি হবে আগামী ১৭ নভেম্বর। যদি রিভিউতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়টি অবৈধ ঘোষণা করা হয়, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হবে বলে মনে করা হয়।
যদিও সেখানে জটিলতা থেকে যাবে পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে। কেননা পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়েও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি বাতিল করে দেওয়া হয় এবং বর্তমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান নেই। সম্প্রতি পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়েও উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছে।