শেখ মুজিবুর রহমানকে ইতিহাস তার নিজস্ব নিক্তিকে বিবেচনা করবে। এখানে বাড়িয়ে বলার সুযোগ কম। কমিয়ে বলারও সুযোগ কম।
বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনিবার্য চরিত্র শেখ মুজিবুর রহমান। তবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অতিকথন ও অতিচর্বণের কারণে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অবস্থান হারিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন স্থানে শেখ মুজিবের বিশাল বিশাল ভাস্কর্য টেনেহিঁচড়ে ভাঙা হয়েছে।
এই ভাঙচুরে নেতৃত্ব দিয়েছেন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। অথচ এই প্রজন্মের মনে ও মননে শেখ মুজিবের স্থায়ী ভাবমূর্তি স্থাপনের কী মরিয়া চেষ্টাই–না আওয়ামী লীগ করেছে। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, এই নতুন প্রজন্মের হাতেই শেখ মুজিবের ভাস্কর্যের ও তাঁর নিজ হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগের করুণ পতন হয়েছে। দলটির বিরুদ্ধে এখন গণহত্যার অভিযোগ। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে স্বচ্ছভাবে বিচার করলে এই দল ও দলের অনেক শীর্ষ নেতারই দণ্ড হতে পারে গণহত্যার দায়ে।
সম্প্রতি বিভিন্ন জাতীয় দিবস বাতিল হয়েছে। সেই সূত্র ধরে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আবার আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে সাতই মার্চকে জাতীয় দিবস হিসেবে বাতিল করার পর আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা আড়ালে–আবডালে থেকেই সরকারের কঠোর সমালোচনা করছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ ঘিরে অজস্র কর্মসূচি পালিত হয়েছিল। এর সব কটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। যেমন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার গঠনের দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেনি। কারণ সম্ভবত এই যে ওই দিন শেখ মুজিবুর রহমান সশরীর উপস্থিত থাকতে পারেননি। তিনি তখন পাকিস্তানের জেলে।
৭ মার্চের ভাষণ গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। সন্দেহ নেই, ওই দিনের ভাষণ ও জনসভা আমাদের মহান স্বাধীনতাসংগ্রামের এক মাইলফলক। কিন্তু ওই ভাষণের পরদিনই স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল—এমনটা বলা যাবে না। সাতই মার্চ অনেকগুলো ধারাবাহিক ঘটনার একটা। ৭ মার্চের পরও আলোচনার টেবিলে কথা হয়েছে। আলাপ হয়েছে। তাই সাতই মার্চ জাতীয় দিবস হিসেবে বাতিল করায় এক পক্ষ যেমন অখুশি হয়েছে, তেমনি আরেক পক্ষ মনে করছে, বাতিল করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এবার মূল আলাপে আসা যাক। শেখ হাসিনার শাসনের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনের যথেষ্ট মিল আছে। তাই শেখ হাসিনার অপশাসন দিয়ে শেখ মুজিবকে মূল্যায়ন না করার কোনো সুযোগ নেই। দুটি কারণ নিয়ে আপাতত বিশ্লেষণ করা যায়। প্রথমত, শেখ হাসিনার শাসনামলে মুজিববন্দনা হয়েছে অতিমাত্রায়। সেই সময় দেশের সর্বত্র শেখ মুজিবুর রহমানের একধরনের জবরদস্তিমূলক উপস্থিতি নিশ্চিত করার চেষ্টা হয়েছে। মুজিববন্দনা ছিল না—এমন জায়গা পাওয়াই ছিল দুষ্কর।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় চাপ দিয়ে করা হয়েছে ‘মুজিব কর্নার’। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমে শেখ মুজিবের ওপর নিবন্ধ ও প্রবন্ধের সংখ্যা ছিল মাত্রাতিরিক্ত বেশি। জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার কারণে নতুন প্রজন্ম শেখ মুজিবকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিবেচনা করতে পারেনি, বরং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার জায়গাটি নষ্ট হয়েছে। এ কারণেই হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মুজিববাদ বাস্তবায়ন বা আওয়ামীকরণের প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে পুরোপুরি।
আরেকটি ব্যাপার মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন শেখ মুজিবের শাসনেরই ধারাবাহিকতা। শেখ হাসিনার শাসনামল পুরোপুরি না হলেও বেশির ভাগই শেখ মুজিবের শাসনের প্রতিচ্ছবি। দুই আমলেই দেশের নির্বাচনব্যবস্থা বলে কিছু ছিল না। সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে শেখ মুজিবের আওয়ামী শাসন। শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়, ডাকসুর নির্বাচনেও সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিজেদের মতো করে বিজয়ী নির্ধারণ করে ফলাফল ঘোষণা করেছিল।
শেখ হাসিনার আমলেও দেশে নির্বাচন বলতে কিছু ছিল না। জাতীয় বা স্থানীয় সরকার নির্বাচন বাদেও শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই একই কায়দায় ডাকসুর নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
এ তো গেল নির্বাচনী ব্যবস্থা; দুই আমলের শাসনব্যবস্থাতেও খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। স্বাধীনতার পর সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করলেও সাড়ে তিন বছরের মাথায় শেখ মুজিব দেশে বাকশাল কায়েম করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এটা পুরোপুরি গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী উদ্যোগ ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মেনে নিয়ে শাসনক্ষমতা শেখ মুজিবের হাতে অর্পণ করেনি বলেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। এই ভূখণ্ডের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনের জন্যই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাসংগ্রামে সবাই অংশ নিয়েছিল গুটিকয় স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া। কিন্তু ১৯৭২ সালের পর রক্ষীবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতন ও একদলীয় বাকশাল কায়েম করায় মানুষ ক্ষুব্ধ ও আশাহত হয়েছিল।