অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দেশের শেয়ারবাজারে, বিশেষ করে সেকেন্ডারি মার্কেটে অর্থাৎ স্টক এক্সচেঞ্জে দারুণ তেজিভাব লক্ষ করা গিয়েছিল। পর পর কয়েক দিন শেয়ার মূল্যসূচক ও লেনদেন, উভয়ই উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক হলেও এর পেছনে বাজার কারসাজির অপচেষ্টা থাকতে পারে বিধায় শেয়ারবাজারে সতর্ক দৃষ্টি রাখার গুরুত্ব উল্লেখ করে কালের কণ্ঠে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। শেয়ার মার্কেটে বাজার কারসাজি হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করে বলা কষ্টকর।
তবে স্টক এক্সচেঞ্জে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে যে বড় মাত্রার উত্থান-পতনের ঘটনা ঘটেছে এবং এর ফলে যে আবারও অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা তো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকেই জানা গেছে। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহের শুরুর দুই কার্যদিবসেই স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে বাজার মূলধন হারিয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এ দুই দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রাম উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার মূল্যসূচকের বড় ধরনের পতন হয়েছে। শেয়ারবাজারের এই ধাক্কা এতটাই অস্বাভাবিক ছিল যে অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারী ক্ষুব্ধ হয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারমানের পদত্যাগ দাবি করে মিছিল-মিটিং করেছে।
সরকার পরিবর্তনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ারমূল্য বৃদ্ধি এবং ঠিক তার কিছুদিন পরই শেয়ার মূল্যসূচকের বড় ধরনের পতনের পেছনে বাজার কারসাজি বা মার্কেট ম্যানিপুলেশনের ঘটনা ঘটেছে কি না তা একমাত্র বিস্তৃত তদন্তের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব। যদিও শেয়ারবাজার এমন এক ধরনের উচ্চ সংবেদনশীল এবং জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ ব্যবস্থা, যেখানে বাজার কারসাজির ঘটনা প্রায়ই ঘটে, কিন্তু বেশির ভাগ ঘটনাই প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের সব স্টক এক্সচেঞ্জে একই অবস্থা। আমাদের দেশের মতো স্টক এক্সচেঞ্জে কাজটি আরো কঠিন, বা বলা চলে প্রায় অসম্ভব।
এর কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই কাজগুলো করা হয় প্রচলিত আইনের ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে। এ ব্যাপারে আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করছি।
২০০১-০২ সালের দিকে আমি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সার্ভেইল্যান্স বিভাগে কর্মরত ছিলাম এবং আমার অন্যতম দায়িত্ব ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন পর্যবেক্ষণ করে কোনো রকম অনিয়ম বা সন্দেহভাজন কিছু পেলে তা খুঁজে বের করা এবং কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে নিয়ে আসা। তখন স্টক এক্সচেঞ্জে বিএটি-বিসি ও বেক্সিমকো ফার্মা ছিল অত্যধিক বাজার মূলধন সংবলিত কম্পানি। ফলে এই দুটি কম্পানির শেয়ারের মূল্য সামান্য বৃদ্ধি পেলেই পুরো মূল্যসূচক অনেক বেড়ে যায়।
আবার এই দুটি কম্পানির শেয়ারের মূল্য সামান্য হ্রাস পেলে মূল্যসূচকের বড় ধরনের পতন হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিএটি-বিসি ও বেক্সিমকো ফার্মার ন্যূনতম, অর্থাৎ মাত্র ৫০টি করে শেয়ার তৎকালীন বাজারমূল্যে মাত্র ১০ হাজার টাকায় ক্রয়-বিক্রয় করার মাধ্যমে পুরো শেয়ার মূল্যসূচক ঊর্ধ্বমুখী বা নিম্নমুখী প্রবণতার দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। এভাবে খুব সহজেই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নিজেদের সুবিধামতো শেয়ার ক্রয় বা বিক্রয়ে প্রলুব্ধ করা সম্ভব ছিল। অর্থাৎ কিছু চতুর বিনিয়োগকারী যদি মনে করত যে শেয়ার মূল্যসূচক সকালে বৃদ্ধি করে বিকেলে হ্রাস করতে পারলে তাদের লাভ হবে, তখন তারা এই দুটি কম্পানির ৫০টি করে শেয়ার সকালে বেশি মূল্যে এবং বিকেলে কম মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় করত। ফলে সকালে পুরো শেয়ারবাজারে চাঙ্গাভাব বজায় থেকেছে, যা বিকেলে মন্দা অবস্থায় ফিরেছে।