গত আড়াই বছরজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করেছে। আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আশা করা হয়েছিল, এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। অথচ মূল্যস্ফীতি এখন এক অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমার মতে, এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির ছয়টি প্রধান কারণ রয়েছে।
১. সরবরাহ–সংকট: বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহের ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। এতে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বৈষম্য দেখা দিয়েছে।
২. চাহিদা ও সরবরাহের তথ্যের ঘাটতি: বাজারে চাহিদার প্রকৃত পরিসংখ্যান ও সরবরাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না। সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান এসব তথ্য সরবরাহ করে, সেসব প্রতিষ্ঠান ও তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
৩. বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব ও ব্যবসায়ীদের কারসাজি: বাজারে সরবরাহ–সংকটের সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী মজুত করে বা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যমূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেন।
৪. সঠিক মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি গ্রহণে ব্যর্থতা: বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সমন্বিত পদক্ষেপের অভাবের কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সঠিক নীতিমালা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
৫. মুদ্রার অবমূল্যায়ন: গত দুই বছরে টাকার মূল্য বড় রকমের কমে যাওয়ার ফলে আমদানি খরচ বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে পণ্যের দামে। কিন্তু এর সঙ্গে সংগতি রেখে আমদানি শুল্ক সামঞ্জস্য করা হয়নি।
৬. জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি: জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য পণ্য উৎপাদন, পরিবহন ও বিতরণের খরচ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে, যা সামগ্রিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।
যদিও এই দীর্ঘায়িত উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল, আগের সরকারের আমলে তা দেখা যায়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও কোনো সমন্বিত উদ্যোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অথচ এ রকম একটি অসাধারণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। আমার মতে, নিচের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার।
১. বাজারের সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের যথাযথ পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা প্রয়োজন। বাজারে কোথায় কোথায় সরবরাহ–ঘাটতি রয়েছে, তা সঠিকভাবে নিরূপণ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তা পূরণ করতে আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে।
২. বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা: সাম্প্রতিক বন্যা খাদ্যপণ্য উৎপাদন ব্যাহত করেছে। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে এবং কৃষিপণ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় পণ্য মজুতের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন এবং প্রয়োজনে আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। দুর্যোগকালে ফসলহানি মোকাবিলায় বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি না দেখা দেয়।
৩. অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির প্রক্রিয়া সহজ করা: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমদানি প্রক্রিয়ায় জটিলতা দূর করতে হবে। দুর্যোগের পূর্বাভাস থাকলে আগেভাগেই আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সংকট সৃষ্টি না হয়।
৪. সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম গঠন: বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমন্বয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করতে হবে। নিয়মিত বৈঠক করে বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
৫. মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির সমন্বয়: বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি নির্ধারণ করবে এবং এনবিআর রাজস্ব নীতি গ্রহণ করবে, যা একে অপরের সঙ্গে সমন্বিত হতে হবে। সুদের হার ও কর রেয়াতের ক্ষেত্রে দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।