এটা ২০০৯ সালের কথা। গ্যেটে ইনস্টিটিউটের দাওয়াতে করাচি গিয়েছিলাম ‘মাইগ্রেশন’ নিয়ে একটি সেমিনারে যোগ দিতে। সেমিনার শেষে আরও কয়েকটি সভায় কথা বলার দাওয়াত পাই। এর মধ্যে একটি নাগরিক সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত সভায় হাজির ছিলেন করাচির অনেক বিদ্বজ্জন, সাংবাদিক ও রাজনীতিক। অডিয়েন্স থেকে একজন আমার দিকে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, একাত্তরের ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচার সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
তখন ঢাকায় যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন নেতার বিচারের দাবি নতুন করে উঠেছিল। এসব খবর পাকিস্তানের গণমাধ্যমে ভালোই প্রচার পেয়েছিল। উপস্থিত শ্রোতা-দর্শকদের অনেকেই আমার পরিচিত, বন্ধু। পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের মধ্যে যে কয়জন উদারপন্থী ও সেক্যুলার মানুষ আছেন, তাঁদের অন্যতম আমার এই বন্ধুরা।
একাত্তর নিয়ে আমার অনুভূতি মিশ্র। আমি ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে আসি জুলাই মাসের শেষের দিকে। নিজের চোখেই অনেক কিছু দেখেছি। মেঘনার পাড় দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় রোজই দেখতাম নদীতে লাশ ভেসে যাচ্ছে। কত মানুষ যে মারা গেছে, তা কোনো দিন গুনে দেখার চেষ্টা হয়নি।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকা মুক্ত হলো। আমি তখন গ্রামে। অনেক জায়গায় শুরু হলো বাঙালির ‘বিহারি’ নিধন; তাদের বাড়ি, গাড়ি, দোকান আর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল। কয়েক দিনের মধ্যেই মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের জনমিতি বদলে গেল। অবাঙালি-অধ্যুষিত এই এলাকাগুলোর বাড়ির মালিক হয়ে গেলেন বাঙালিরা। তাঁরা নানা বর্ণের ‘মুক্তিযোদ্ধা’; কেউ প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা, ৯ মাস ছিলেন ভারতে। কেউ ষোড়শ ডিভিশনের সদস্য। সবার হাতে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র। কেউ কেউ অবশ্য ‘জেনুইন’ মুক্তিযোদ্ধা।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে অনেক। মোটের ওপর তখন একটা প্রলয় নেমে এসেছিল বাঙালির জীবনে। এমনটি এর আগে কখনো হয়নি। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজের শিকার হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। যারা এ জন্য দায়ী, বিজয়ীদের হাতে তাদের বিচার হবে, এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধের সময় উভয় পক্ষের যোদ্ধারা একে অপরকে হত্যা করেন। যুদ্ধ মানেই হত্যাকাণ্ড। কিন্তু নিরস্ত্র অসামরিক ব্যক্তি কিংবা বন্দী সামরিক-অসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা করা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধ। একাত্তরে এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে অনেক।
আমি করাচিতে বসে কথা বলেছি ২০০৯ সালে। একাত্তরে ও তার পরে বাড়িঘর, সম্পদ-সম্ভ্রম হারিয়ে অনেক অবাঙালি চলে এসেছেন করাচিতে। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে ৩৮ বছর। এত দিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। ১৯৭৩ সালের নভেম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে স্বাধীনতাবিরোধীদের জেল থেকে ছেড়ে দেয়।
১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব লাহোর গেলে বিমানবন্দরে তাঁকে যাঁরা স্বাগত জানান, তাঁদের একজন ছিলেন গণহত্যার নির্দেশদাতা জেনারেল টিক্কা খান। শেখ মুজিবের সঙ্গে টিক্কা খানের সহাস্য করমর্দনের ছবি পত্রিকায় দেখে অনেকেই আহত হয়েছিলেন। মুজিবের ওই সফরের ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ দর-কষাকষির ক্ষমতা অনেকটাই হারিয়েছিল। এরপরই ভারতে আটক পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যর্পণ শুরু হয়। সেই সঙ্গে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীও মুক্তি পান। অবশ্য টিক্কা খানকে যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাতেই রাখা হয়নি।
প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম, একাত্তরে বাংলাদেশে ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায় আছে উভয় পক্ষের। কিছু প্রতীকী বিচার করে একটা রিকনসিলিয়েশনের জানালা খোলা দরকার। আমাকে খুব সাবধানে শব্দচয়ন করতে হচ্ছিল।
আমরা জানি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ ‘ইমিউনিটি’ বা দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ তাঁদের দ্বারা সংঘটিত কোনো কিছু ‘অপরাধ’ হিসেবে দেখা হবে না। ফলে ‘বিহারি’র বাড়ি-দোকান দখল জায়েজ হয়ে যায়। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে মতিঝিলে শেখ ফজলুল হক মনি উর্দু দৈনিক পাসবান-এর অফিস ও প্রেস দখল করে দায়মুক্তি পেয়ে যান। সেখান থেকে তিনি বাংলার বাণী পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকেন।
সেই থেকে এ দেশে দায়মুক্তির ধারা চলে আসছে। ১৯৭৪ সালে জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এটি ছিল সরকারের প্রাইভেট বাহিনীর মতো। এই বাহিনীর আদলেই শেখ হাসিনা পরবর্তীকালে গড়ে তুলেছিলেন ‘হেলমেট বাহিনী’। এদের সাত খুন মাফ!
২০০১-২০০৪ সালে খালেদা জিয়ার সরকার অপারেশন ক্লিন হার্ট চলাকালে যৌথ বাহিনীকে দায়মুক্তি দেয়। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাতাদের একধরনের দায়মুক্তি দেন। ‘দ্রুত বিদ্যুৎ জ্বালানি সরবরাহ আইন’-এর আওতায় টেন্ডার ছাড়াই প্রকল্প অনুমোদন দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো কুইক রেন্টাল ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প। এগুলো এখন ফাঁসির দড়ি হয়ে আমাদের গলায় ঝুলছে আর আমরা কাফফারা দিয়ে যাচ্ছি।
সর্বশেষ দায়মুক্তির ঘটনা হাল আমলের। এ বছর ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তরুণদের কর্মকাণ্ডকে একধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে কিছু শোরগোল হচ্ছে। আন্দোলনকারী পক্ষ বলছে, এ সময়ে ঘটে যাওয়া ধ্বংসাত্মক কাজগুলোর দায় তারা নেবে না। যেমন মেট্রোস্টেশন পোড়ানো, থানায় আগুন দিয়ে পুলিশ মারা ইত্যাদি। বলা হচ্ছে, এসব হলো ‘মব ভায়োলেন্স’, যার জন্য আন্দোলনকারীরা দায়ী নন।