প্রথাগতভাবে ‘অগ্রগতি’ ও ‘উন্নয়ন’ শব্দদ্বয় সমার্থক বলে মনে করা হয়। তাই শব্দ দুটিকে প্রায়ই অদলবদল করে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু শব্দের অর্থ পেরিয়ে যখন ধারণার নিরিখে ‘অগ্রগতি’ ‘উন্নয়ন’কে দেখা হয়, তখন তাদের মৌলিক পার্থক্য স্পষ্ট ধরা পড়ে।
অগ্রগতি হচ্ছে একধরনের পরিমাণগত বৃদ্ধি কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হ্রাস। এবং সেটা যেকোনো সূচকের হতে পারে, যেমন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জাতীয় আয়, গড় আয়ু এবং হ্রাসের ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার, বেকারত্বের হার ইত্যাদি। অন্যদিকে উন্নয়ন হচ্ছে অগ্রগতির সঙ্গে গুণগত রূপান্তর—কাঠামোর পরিবর্তন, মানসিকতার সংস্কার, মূল্যবোধের বদল, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ইত্যাদি। অন্য আঙ্গিক থেকে বলা যায়, অগ্রগতি হচ্ছে উল্লম্বিত বৃদ্ধি বা হ্রাস আর উন্নয়ন হচ্ছে আনুভূমিক রূপান্তর, অগ্রগতি একরৈখিক, উন্নয়ন ব্যাপ্ত।
সুতরাং উন্নয়নের জন্য দুটি জিনিস অতীব প্রয়োজন—উন্নয়ন দর্শন ও নৈতিকতার উন্নয়ন। উন্নয়নে যে জাতীয় গুণগত রূপান্তর কাঙ্ক্ষিত, তার একটি দর্শনগত ভিত্তি থাকা প্রয়োজন। যে উন্নয়ন পথযাত্রা আমরা অনুসরণ করছি তা নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। তা কি সমাজে বঞ্চনা বর্ধন করে, না হ্রাস করে? দেশে তা বৈষম্য বাড়ায়, না কমায়? উন্নয়নপ্রক্রিয়াটি কি অংশগ্রহণমূলক নাকি চাপিয়ে দেওয়া? পুরো ব্যাপারটি কি দেশজ সংস্কৃতির অনুগামী নাকি শিকড়বিহীন? এটি কি পরিবেশবান্ধব নাকি পরিবেশক্ষয়ী?
উন্নয়নের ফলাফল ও উন্নয়নপ্রক্রিয়া উভয় প্রেক্ষিতেই এ প্রশ্নগুলো উন্নয়নের দর্শনকে ব্যক্ত করে। যেমন আমরা যখন বলি যে আমরা বৈষম্যহ্রাসকারী উন্নয়ন চাই, তখন বোঝা যায় যে ফলাফলের দিক থেকে আমরা একটি সুষম সমাজের প্রত্যাশী। তেমনি অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের কথা বললে প্রতীয়মান হয় যে উন্নয়নপ্রক্রিয়ার সর্বজনিনতার কথা বলা হচ্ছে।
উন্নয়ন দর্শনকে আরও বিস্তৃত করলে পুঁজিবাদী উন্নয়ন বনাম সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের কথা চলে আসে—পুঁজিবাদের পথ ধরে উন্নয়নের পথযাত্রা অনুসরিত হবে, নাকি তা সমাজতন্ত্রের পথে চলবে। সুষম উন্নয়নের কথাও বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত হয়েছে, যেখানে উন্নয়নের নানান মাত্রিকতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কথা জোরালোভাবে উঠে এসেছে। নারী-পুরুষের মধ্যে সাম্য, পরিবেশ সংরক্ষণ, আন্তঃপ্রজন্ম ভারসাম্য বিষয়গুলোও উন্নয়ন ভাবনায় এসেছে।
বেশ কিছুদিন ধরে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষকে প্রতিস্থাপন উন্নয়ন দর্শনের নিরিখে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এর প্রবক্তারা বারবার বলেছেন যে মানুষের জন্যই উন্নয়ন, উন্নয়নের জন্য মানুষ নয়। এসব চিন্তাচেতনার ধারণার হাত ধরেই মানব উন্নয়ন ধারণার জন্ম ও বিস্তার। প্রবৃদ্ধিতত্ত্বের বিপরীতেই উঠে এসেছে মানব উন্নয়নের ধারণা।
প্রবৃদ্ধিতত্ত্বের উন্নয়ন দর্শন হচ্ছে আয়ের প্রবৃদ্ধিই হচ্ছে উন্নয়ন—তত্ত্বের দিক থেকে ও পরিমাপের দিক থেকেও। এই তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে, ব্যক্তিজীবনে ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আয় বাড়লেই ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার মান বাড়বে এবং সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধিও মজবুত হবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে দেখা গেছে যে দেশের জাতীয় আয় হয়তো বেড়েছে, কিন্তু ব্যক্তিমানুষের তাতে কোনো লাভ হয়নি, আয় বৃদ্ধি সমভাবে বণ্টিত হয়নি, জাতীয় আয়ের সুফল ব্যক্তিজীবনে পৌঁছায়নি। ব্যক্তিমানুষ উন্নয়নের প্রান্তসীমাতেই থেকে গেছে।