দুজন বন্দীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল কথিত এক সেফ হোমে। সেখানে আটক এই দুই মেধাবী কিশোরীর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয় সেবার। শিরোনামের অনুরোধটা ছিল তাদেরই।
দুই বোন—দুজনই এসএসসিতে সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়ে ভালো কলেজে ভর্তি হয়েছিল। পাঠক্রমের বাইরেও তাদের অনেক জানাশোনা। প্রমিত বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও ভালো বলে। উচ্চমাধ্যমিক পড়তে পড়তে দুই বোনের ‘মতিভ্রম’ (তাদের অভিভাবক এবং সেফ হোমের কর্মকর্তাদের মতে) ঘটে। দুই বোন তাদের পরিবারের ধর্ম ত্যাগ করে। এর ফলে তাদের লেখাপড়া বন্ধ আর সেফ হোমে প্রেরণ। সেফ হোমটিতে বেশির ভাগই হচ্ছে সরকার নির্ধারিত বয়সের আগে বিয়ে করে ফেঁসে গেছে এমন। পরিবার দিয়েছে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা। ছেলেটি ধরা পড়ে জামিন অযোগ্য হাজতবাসে আছে। আর কিশোরীটির দিন কাটছে অসহ্য এক বন্দিখানায়। এদের কয়েকজন সদ্য মা হয়েছে এমনও আছে।
মাঝেমধ্যেই সেফ হোমের কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। তবে বেশির ভাগ খবরে থাকে সেফ হোম থেকে কিশোরীদের ‘পালিয়ে’ যাওয়ার ঘটনা। সম্প্রতি ছাপা হওয়া একটা খবর পড়ে মনে হতে পারে, এটা একটা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। কিন্তু তিন–চারটা দপ্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ঘটা সে ঘটনা কতটা তাৎক্ষণিক অথবা কতটা নিয়মিত, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। অপহরণ থেকে উদ্ধারের পর ঠাকুরগাঁওয়ের এক কিশোরীকে নিরাপত্তার কারণে রাজশাহী সেফ হোমে রাখা হয়।
সেই কিশোরীকে সম্প্রতি সরকারি ব্যবস্থাপনায় ঠাকুরগাঁওয়ে নিয়ে গিয়ে আসামিদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ, রাজশাহীর সেফ হোমের সুপারিনটেনডেন্ট এবং ঠাকুরগাঁও সমাজসেবা দপ্তরের প্রবেশন অফিসারদের চতুর সমন্বয় ছাড়া এ ধরনের দেখাসাক্ষাৎ একেবারেই অসম্ভব। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ভুল স্বীকার করে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন রাজশাহীর সেফ হোমের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট। যাঁর কথায় তিনি কিশোরীটিকে ঠাকুরগাঁও পাঠিয়েছিলেন, সেই প্রবেশন অফিসার (সমাজসেবা কার্যালয় ঠাকুরগাঁও) কিংবা পুলিশ, যাঁদের চাঁদোয়ার নিচে আসামিরা কাণ্ডটা ঘটাল, তাদের কোনো কৈফিয়ত কি চাওয়া উচিত নয়?
এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, সেফ হোম কতটা অনিরাপদ। সম্প্রতি একটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে গবেষণার কাজ করতে এসেছিলেন বিদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। নিবাসীদের সঙ্গে একান্তে কথা বলে তিনি সেখানকার একশ্রেণির কর্তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ শুনেছেন, তার সিকি ভাগও যদি সত্য হয়, তবে বলতে হবে কিশোরেরা নরকে আছে। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে এর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা নিবাসীদের যেকোনো ঝুঁকিতে ফেলতে পরোয়া করে না।
বাংলাদেশে বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে গাজীপুর সেফ হোম ছাড়া আরও ছয়টি সেফ হোম আছে। সেগুলোতে মোট ৩০০ জন থাকতে পারেন। সেখানে আছেন মোট ৪৩৩। এর প্রায় অর্ধেকই প্রতিবন্ধী নারী ও মেয়েশিশু। দেশের বাইরেও ছয়টি (রিয়াদ, জেদ্দা, মদিনা, ওমান, জর্ডান, লিবিয়া ও লেবানন) সেফ হোম আছে। সেগুলোকে অবশ্য সেফ হাউস বলা হয়। হোম আর হাউস যা–ই হোক, উভয় জায়গায় নারীদের সর্বাধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য।
প্রথম আলোয় রাফসান গালিব গত ২৬ জুলাই ২০২৩ তাঁর এক লেখায় রিয়াদের সেফ হাউস নিয়ে বিস্তারিত লিখেছিলেন। সেখানে একজন উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা দিনের পর দিন আশ্রিত নারীদের হেনস্তা ও ধর্ষণ করছেন। প্রমাণিত হওয়ার পরও তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়নি। তাঁকে আইনে সোপর্দ করা হয়নি। সেফ হোমের গরিব–অসহায় নিবাসীদের পক্ষে আওয়াজ তোলার যে কেউ নেই। রাষ্ট্র আর তার আমলাতন্ত্র চোখ বন্ধ করে থাকে।