সবাই কি ভিসি হতে চান? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ‘না’। নিশ্চয়ই সব শিক্ষক ভিসি হতে চান না। কেননা ক্লাসে পড়ানো আর ভিসিগিরি করার মধ্যে তফাৎ ঢের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক এই সেদিন ভিসি হওয়া নিয়ে রসিকতা শুরু হওয়ার পর ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘ভিসি হতে চাই না, পড়াতে চাই, পড়ানোর পরিবেশ তৈরি করুন।’ একজন শিক্ষকের কথা বললাম, কিন্তু এমন অনেক জনের কথা আমরা জানি, যারা ভিসি হওয়ার প্রস্তাব পেলেও সেটা গ্রহণ করবেন না। ভিসি পুরোপুরি একটি প্রশাসনিক পদ। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি করার তার প্রধান দায়িত্ব। ভিসিরা কয়জন তা করতে চেষ্টা করেছেন? এই পদাধিকারীর অনেক ক্ষমতা। দুর্জন শিক্ষক যদি ভিসি হন, তাহলে তার পক্ষে এই পদে বসে প্রচুর মালকড়ি কামানোও সম্ভব। অনেক ভিসির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আছে। বরং বলা ভালো, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খুব কম ভিসিই বিতর্কমুক্ত থাকতে পেরেছেন বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম ভিসি খুঁজে পাওয়াই খুব কঠিন যার বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতিসহ অন্য আরও এক বা একাধিক অভিযাগ ওঠেনি।
৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন শিক্ষার্থীদের পড়ানোর পরিবর্তে উপাচার্য বা উপ-উপাচার্য হতে বেশি আগ্রহী। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো ৩০০, ৪০০ বা ৫০০ শিক্ষক আছেন; কিন্তু তারা সবাই কেন ভিসি হতে চান, আমি বুঝি না। তিনি আরও বলেন, ‘আমি সবসময় একজন ভালো শিক্ষক হতে চেয়েছি, ভিসি হতে চাইনি।’
যদিও ওইদিনই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো একটি বিবৃতিতে বলা হয়, পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা একনেক সভার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো জানানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। শুরুতে তার ব্যস্ততা ও শারীরিক ক্লান্তির কথা বুঝাতে তিনি বলেছিলেন, তার কাছে চারশ থেকে পাঁচশ ভিসি, প্রো-ভিসি হওয়ার আবেদন আছে, যা তিনি এখনো যাচাই-বাছাই শেষ করতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি মজার ছলে বলেছিলেন, সবাই ক্লাসে পড়ানোর চাইতে এসব পদে যেতেই আগ্রহী।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ হয়তো মজার ছলেই বলেছেন। তিনি একজন সজ্জন মানুষ হিসেবে পরিচিত। অহেতুক বিতর্ক তৈরি করা বা কাউকে ছোট করা তার চরিত্রের সঙ্গে বেমানান। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি মজার ছলে হলেও একটি নির্মম সত্য বলেছেন— যা সম্পর্কে দেশের সচেতন নাগরিকদেরও কমবেশি ধারণা আছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এমনকি প্রক্টর পদে থাকা অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যেসব দলীয়করণ (দলবাজি) ও নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে; এইসব পদে নিয়োগ নিয়ে যে ধরনের রাজনীতি হয়েছে বা এই পদগুলোকে যেভাবে দলীয় আনুগত্যের পুরস্কারে পরিণত করা হয়েছে এবং সর্বোপরি এইসব পদকে যেভাবে ক্ষমতার কেন্দ্র ও টাকা কামানোর মেশিনে পরিণত করা হয়েছে— তাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিরাট অংশের মনে ভিসি, প্রো-ভিসি, প্রক্টর হওয়ার বাসনা তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতো নির্লোভ, সৎ ও আন্তরিক শিক্ষকের সংখ্যা কি আসলে খুব বেশি যারা কোনোদিন এসব প্রশাসনিক পদে যেতেই চাননি?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের একটা গড় চেহারা তুলে ধরেছিলেন আহমদ ছফা তার ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসে। সেই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘গোয়ালঘর’ বানানোর প্রতিফলন দেখা গেছে।
আশা করতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গোয়ালঘর বানানোর যে অবস্থা করা হয়েছিল, তা থেকে উত্তরণ ঘটবে। বিগত অনেকগুলো সরকারের আমলে দেখেছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদেরকে যে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়, এটি ছিল ওপেন সিক্রেট। অর্থাৎ ব্যক্তি হিসেবে তিনি যতই উন্নত চরিত্রের হোন না কেন; তার অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার যতই উজ্জ্বল হোক না কেন; প্রশাসক হিসেবে তিনি যতই দক্ষ হোন না কেন— দলীয় আদর্শের ব্যাপারে তিনি যদি নিজের অবস্থান সুস্পষ্ট করতে না পারেন এবং নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শনে ব্যর্থ হন, তাহলে তার পক্ষে উপাচার্য তো দূরের কথা, উপ-উপাচার্য হওয়ারও সুযোগ ছিল না। আর যখনই কেউ এভাবে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক বলয়ের ভেতরে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে নিয়োগ পান, তখন তিনি ওই ক্ষমতাকে প্রথমত কাজে লাগান নিজের ও পরিবারের আর্থিক উন্নয়নে। তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশ উন্নয়নের মতো বিষয়গুলো অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকে না। তার বড় অগ্রাধিকার যেহেতু বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে অর্থ উপার্জন, ফলে তার অধিক আগ্রহ থাকে অবকাঠামো নির্মাণ, বিভিন্ন কেনাকাটা এবং অবশ্যই নিয়োগে। আর এইসব করতে গিয়ে তিনি তার শিক্ষক চরিত্র থেকে বিচ্যুত হয়ে অপরাপর দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাতারে চলে যান।