বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী কর্মী হিসেবে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়া একটি বিশাল শ্রমবাজার। প্রতিবছর হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মূলত নির্মাণশিল্প, কৃষিকাজ ও উৎপাদনশিল্পে কাজের আশায় মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। তবে এই অভিবাসনপ্রক্রিয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়ায় যাওয়ার খরচ প্রায় আকাশচুম্বী, যা পরবর্তী সময় তাঁদের জন্য এক অসহনীয় আর্থিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। উপরন্তু, মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর অনেক শ্রমিক প্রতিশ্রুত বেতন ও কাজ না পেয়ে নানান প্রতারণার শিকার হন। এর একটি বড় কারণ হলো, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এ সিন্ডিকেট নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণার সুযোগ তৈরি করেছে। এই সিন্ডিকেটের নানা দুর্নীতির খবর দেশবাসী এরই মধ্যে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন।
বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই এ সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন মডেল, যেমন বিজনেস-টু-বিজনেস (বিটুবি), গভর্নমেন্ট-টু-গভর্নমেন্ট (জিটুজি) এবং গভর্নমেন্ট প্লাস বিজনেস-টু-বিজনেস (জি-প্লাস-বিটুবি) প্রয়োগ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এসব মডেলের কোনোটিই এখন পর্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। বিদ্যমান শক্তিশালী সিন্ডিকেট, দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগী চক্রের কারণে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকেরা একদিকে যেমন উচ্চ খরচ বহন করতে বাধ্য হচ্ছেন, অন্যদিকে তাঁরা বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন। তাই এখনই সময়, বাংলাদেশ সরকারের একটি নতুন ও কার্যকর মডেল গ্রহণ করার, যা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য এবং খরচ কমানোর পাশাপাশি শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার নিরিখে আমরা কিছু নতুন মডেল প্রস্তাব করছি, যা স্বল্প মেয়াদে বাস্তবায়ন করা সম্ভব এবং দীর্ঘ মেয়াদে অভিবাসনপ্রক্রিয়ায় সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারে। বাংলাদেশ সরকার মালয়েশিয়ার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের জন্যও এ মডেল অনুসরণ করতে পারে।
ফিলিপাইন মডেল: সরকারি ব্যবস্থাপনায় চাকরির নিশ্চয়তা ও অভিবাসন বিমা
ফিলিপাইন বিশ্বজুড়ে তাদের প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি সফল নিয়োগব্যবস্থা চালু করেছে। বাংলাদেশ এই মডেল থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এবং তাৎক্ষণিকভাবে এই মডেলের কিছু উপাদান নিজ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারে।
কীভাবে এটি কাজ করে
চাকরির ব্যবস্থা ও নিয়োগ: ফিলিপাইন সরকার সরাসরি নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে কাজ করে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য উপযুক্ত চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। এতে মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালের প্রয়োজন না হওয়ায় শ্রমিকদের খরচ কমে আসে। বাংলাদেশেও বিএমইটি একই পদ্ধতিতে সরাসরি মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে কাজ করে নিয়োগপ্রক্রিয়াটি সহজ করতে পারে।
অভিবাসন বিমা ও সুরক্ষা তহবিল: ফিলিপাইন সরকার তাদের শ্রমিকদের জন্য একটি অভিবাসন বিমা প্যাকেজ চালু করেছে, যা শ্রমিকদের চিকিৎসা, আইনি সহায়তাসহ প্রয়োজনীয় পুনর্বাসন সুবিধা দেয়। বাংলাদেশও বিএমইটির অধীন এমন একটি সুরক্ষা তহবিল চালু করলে শ্রমিকদের যাবতীয় সমস্যায় সরাসরি সহায়তা দেওয়া যাবে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এ ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থায় তাঁরা কাজের সময়ে যেকোনো সমস্যায় পড়লে সহায়তা পাবেন।
ইথিক্যাল রিক্রুটমেন্ট মডেল: আইওএমের আইআরআইএস সার্টিফিকেশন
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা, আইওএমের আইআরআইএস (ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটমেন্ট ইন্টেগ্রেটি সিস্টেম) সার্টিফিকেশন মডেলটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যা নিয়োগপ্রক্রিয়ায় নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। এই মডেলের অধীন রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোকে উচ্চ নৈতিক মান অনুসরণ করতে হয়। এর মধ্যে স্বচ্ছ ফি প্রদান ও শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশেও মডেলটি ব্যবহার করে একটি সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যেখানে শুধু স্বীকৃত, স্বচ্ছ ও নৈতিক নিয়োগকর্তারাই অভিবাসী শ্রমিক নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন।