এ নিবন্ধ প্রকাশের সময় ডিমের ডজনপ্রতি দাম ১৮০ টাকা হয়ে গেলে অবাক হব না। এর দাম বৃদ্ধির প্রবণতা তো খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছিল। সেটা খেয়াল করেই বোধহয় মাঝে ডিমের ‘যৌক্তিক দাম’ নির্ধারণ করে দেয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। সঙ্গে ব্রয়লার আর ‘সোনালি’ মুরগির দামও। খাত সংশ্লিষ্টদের মত নিয়েই এটা করার কথা জানানো হয়েছিল। তবে এর চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই মিডিয়ায় খবর আসে– নির্ধারিত দামে ওইসব মিলছে না। পাইকারি বা খুচরা কোনো পর্যায়েই নয়। এ নিবন্ধ লেখার সময় একটি প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণে দেখলাম, ফরিদপুরে এক পাইকারি বিক্রেতাকে জরিমানা করা হয়েছে নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি না করায়। তিনি কেনাবেচার রসিদও দেখাতে পারেননি। অন্য এক ব্যবসায়ী অবশ্য প্রতিবেদককে বলেন, খামারির কাছ থেকেই যৌক্তিক দামের বেশি দিয়ে ডিম নিতে হয়েছে তাকে। এখন কীভাবে এর চেয়ে কম দামে বেচবেন?
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সম্ভবত রাজধানীতেও অভিযান পরিচালনা করছে ডিমের বাজারে। তারা খামারি পর্যায়ে যাচ্ছেন বলে শোনা যায়নি। ফরিদপুরের ওই ব্যবসায়ীর বক্তব্য সঠিক হয়ে থাকলে কিন্তু বলতে হবে, খামারিরাও এখন কিছুটা বেশি দাম পাচ্ছেন। তাদের তরফ থেকে বলা হয়ে থাকে– ব্যবসা করে পোষাচ্ছে না। খামারিদের মধ্যে অবশ্য ছোট ও বড় আছেন। ছোট খামারিদের একাংশ বাজার থেকে হারিয়ে গেছে বলেও জানা যায়। কোভিডের সময় থেকে প্রক্রিয়াটি চলমান। সম্প্রতি দেশের পূর্বাঞ্চলের বন্যায় অনেক খামারি বেজায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের মধ্যে আছেন ডিম উৎপাদকও। এ কারণে বাজারে ডিমের সরবরাহ কম বলে তখন থেকেই শোনা যাচ্ছিল। থেকে থেকে এর দাম বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়েও বলা হচ্ছিল সেকথা। পরে উত্তরাঞ্চলে এবং হালে ময়মনসিংহ বেল্টেও বন্যা হচ্ছে। সে কারণেও ডিমের সরবরাহ কমার কথা। ব্রয়লার মুরগির দামেও লাফিয়ে বাড়ার প্রবণতা উপস্থিত। ব্রয়লারের খামারও নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ অবস্থায় নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারা খামারিরা স্বভাবতই কিছু বেশি দাম পাবে। অতীতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে এতে কিছুটা পুষিয়ে যাবে তাদের। এ খাতের ‘করপোরেট ব্যবসায়ীরা’ হয়তো আরও বেশি লাভবান হবে। বৃহদায়তন উৎপাদনের কারণে তাদের গড় ব্যয় কম হওয়ার কথা। এদের একাংশ ফিড তৈরি আর মুরগির বাচ্চা সরবরাহের ব্যবসাও করে থাকে। এক খাতের মুনাফা দিয়ে অন্য খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুবিধাও তাদের রয়েছে। ছোট খামারিদের তা নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও মূলত এরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এদের রক্ষায় বিশেষ প্রণোদনার তাই বিকল্প নেই। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে বলেই এদের রক্ষা করতে হবে, তা নয়। প্রাণিজ প্রোটিন চাহিদা মেটানোয় বড় ভূমিকা রাখছে বলেও এদের টিকিয়ে রাখা জরুরি। দেশে পরিভোগ হওয়া ডিমের প্রায় ৮০ শতাংশই ছোট খামারিরা জোগাচ্ছে। কোনো কারণে এরা প্রভূত ক্ষতির শিকার হলে জনগণের পুষ্টি প্রাপ্তির ধারাটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ডিম উৎপাদকরা ভালো দাম পেলে তাই ভেবে আশ্বস্ত হওয়া যাবে যে, তারা ব্যবসায় আগ্রহ হারাবে না। তবে তারা ভালো দাম না পাওয়া সত্ত্বেও যদি বাজারে ডিমের দাম বাড়ে এবং এতে কেবল লাভবান হয় ‘মধ্যবর্তীরা’, তাহলে সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে এ দিকটি খতিয়ে দেখা।
অন্তর্বর্তী সরকার এখন দেশ পরিচালনা করছে। ডিমসহ নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক রাখার দায়িত্বও এখন তাদের। গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক সরকারের পতনের পর তারা স্বাভাবিক পরিস্থিতি পেয়েছেন, সেটা বলা যাবে না। তাদের পক্ষে প্রত্যাশিতভাবে দায়িত্ব পালন করা কঠিন। তবে দু’মাস না যেতেই তুলনা শুরু হয়ে গেছে– সরকারটি দায়িত্ব গ্রহণের পর পণ্যবাজারের অবস্থা কী। চলমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে এটা অস্বাভাবিকও নয়। ইট বা রডের দাম যেমনই হোক; নিত্যব্যবহার্য খাদ্যসামগ্রীর বাজার স্বাভাবিক থাকুক– এটা বিশেষত স্বল্প আয়ের মানুষের একান্ত প্রত্যাশা। তারা তো দেশের সিংহভাগও বটে। আর যেসব পণ্যের দাম নিয়ে এরা চিন্তিত, তার মধ্যে স্বভাবতই রয়েছে ডিম। এটা প্রোটিনের ‘সহজতম উৎস’ বলে পরিচিত। দীর্ঘদিন এর দাম ব্যাপক মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকায় ডিমকে সহজলভ্য রাখার দাবিও জোরদার। সহজে ও বিচিত্রভাবে পরিভোগ করা যায় বলেও ডিমের চাহিদা সর্বস্তরে। বেকারিশিল্পেও এর বিপুল ব্যবহার রয়েছে। ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এসব ক্ষেত্রেও পণ্যের দাম যায় বেড়ে। তাই বলে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও জাতিকে সস্তায় ডিম জুগিয়ে যাবে, এটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা নয়। তারা লাভবান হোক এবং ডিমের অধিকতর উৎপাদনে উৎসাহী হয়ে উঠুক, সেটাই বরং ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাশা। এ অবস্থায় ডিমের ‘কাম্য দাম’ নির্ধারণ হওয়া প্রয়োজন, যা ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছেই হবে গ্রহণযোগ্য।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কি সেটাই করতে চাইছে? বিগত সরকারের আমলেও অন্যান্য কৃষিপণ্যের সঙ্গে ডিমের যৌক্তিক দাম স্থির করে দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু তখনও সেটা কার্যকর হয়নি বাজারে। এ অবস্থায় তখনও সম্ভবত কিছু জরিমানা করা হয়েছিল বিক্রেতাদের। সেটাও ছিল বৈষম্যমূলক। কারণ বেশি দামে ডিম বিক্রি করা সবাইকে তো জরিমানা করা যায়নি। এভাবে ‘অভিযান’ পরিচালনায় অনেক সময় বাজার উল্টো অস্থির হয়ে ওঠে। বাজার অর্থনীতিতে দাম বেঁধে দেওয়ার ‘যৌক্তিকতা’ নিয়েও প্রশ্ন কম নয়। এটা সাধারণত কার্যকর হতেও দেখা যায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের অল্প সময়ের মধ্যেও ডিমের ক্ষেত্রে কিন্তু ঘটলো একই ঘটনা। এ সরকারে রয়েছেন ক’জন সুযোগ্য অর্থনীতিবিদ। তা সত্ত্বেও দাম বেঁধে দিয়ে পণ্যবাজার শান্ত রাখার চেষ্টা কেন চলছে, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিছুদিন আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তিনটি খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে এনবিআরকে বলেছিল শুল্ক ছাড়ের ব্যবস্থা করতে। এর মধ্যে ছিল ডিমও। ডিম আমদানি করতে হলে কম ব্যয়ে যাতে আনা যায়, সেজন্যই শুল্ক ছাড় চাওয়া হয়েছিল। তবে এনবিআর অন্য দুটি পণ্যে ছাড় দিলেও ডিমের শুল্ক কমায়নি। ‘যৌক্তিক দাম’ নির্ধারণের চাইতে সেটা বরং হতো ভালো পদক্ষেপ। এখন এনবিআরকে প্রশ্ন করা যেতে পারে, তারা কেন ডিমের ওপর আরোপিত কর-শুল্ক কমাননি?
ডিমে সব মিলিয়ে ৩৩ শতাংশ শুল্ক আরোপিত বলে জানা যায়। উৎপাদনে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের’ পর ডিমের উচ্চ শুল্ক নিয়ে কখনও তেমন খবর হতে অবশ্য দেখা যায়নি। কারণ আমদানির প্রশ্ন কখনও উঠতো না। তবে বিগত সরকারের শেষদিকে ডিম আমদানির প্রশ্ন ওঠায় এর ওপর আরোপিত শুল্কের প্রসঙ্গটি সামনে আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও এরই মধ্যে কিন্তু কিছু ডিম এসেছে ভারত থেকে। ২ লাখ ৩১ হাজার পিস ডিমের একটি চালান এসেছে। এতে অবশ্য দেখা যাচ্ছে, বিদ্যমান শুল্ক দিয়েও দাম পড়ছে পিসপ্রতি প্রায় সাড়ে সাত টাকা। তবে দে’দেশে পরিবহন ব্যয়, অন্যান্য খরচ ইত্যাদি যোগ করে দাম শেষতক কত পড়বে, কে জানে! এ ডিমের দাম কিছুটা কম পড়লেও কথা আছে। মানুষ দেশে উৎপাদিত ডিমই খেতে চায়। আর আমদানি হয় সাধারণত সাদা ডিম, যার প্রতি আকর্ষণ কম। তাছাড়া আমদানি হয়েছে চাহিদার চেয়ে অনেক কম। ওই চালান রাজধানীতে এসে পৌঁছেওনি। এর কোনোই প্রভাব পড়েনি বাজারে। এরই মধ্যে নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে ডিমের দাম।