শিক্ষার্থী-জনতার বিপ্লবপূর্ববর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে খুব বেশি প্রয়োজনীয় মনে হত না। বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বেশি সময় দেওয়াকে বিপজ্জনক কাজ বলে নিরুৎসাহিত করতাম। কিন্তু শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই মাধ্যমগুলোর ভূমিকা আমার আগের অবস্থান পরিবর্তনে বাধ্য করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকে পরিমিতিবোধের দিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে।
সম্ভবত ১৬ সেপ্টেম্বর, ফেসবুক ঘাঁটতে গিয়ে এক শিক্ষার্থীর প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন নজরে এল। ছবিটি সেই ছবিগুলোর একটি, যা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রীকে কোনো একজন যুবক মারধর করেছে অথবা করতে উদ্যত হয়েছে। এ ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী, সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমান শিক্ষকদের কাছে যতটা মর্মান্তিক, তার চেয়ে লজ্জার। মনে হয়েছিল নিজের বাড়িতে নিজের মেয়েদের বাইরের লোকজন এসে মেরে চলে গেল। আর আমরা কাপুরুষের মতো তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম।
এটা বেদনার এই জন্য যে নিজের মেয়েদেরও আমরা নিজেদের ঘরে—এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা দিতে পারলাম না। ছাত্রীদের ওপরে আক্রমণ, আক্রমণের চরিত্র ও ধরন এবং আক্রমণকারীদের পরিচয় (যতটুকু পত্রিকায় এসেছিল), তা দেখে ঘরে থাকা কারও কারও জন্য প্রায় অসম্ভব ছিল। সেদিন গুটিকয় শিক্ষক সেই পীড়ন অনুভব করে বের হয়েছিলেন। শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনে সেই ছবিটা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল, অন্তত আমার ক্ষেত্রে।
এই ছবিটাসহ আর কতগুলো ছবির কারণেই আমরা কেউ কেউ ঝুঁকি সত্ত্বেও শিক্ষার্থী আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করি। ১৬ সেপ্টেম্বর সেই পীড়নের কথা মনে হতেই নিজের ফেসবুকে একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করি। এক শিক্ষার্থী সেদিন মেসেজ করে জানিয়েছিল যে তারা একটি আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কমিশন গঠনের দাবিও করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর এই হামলার ঘটনা তদন্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গত প্রশাসনও একটা কমিটি করেছিল। সেই কমিটির কাজ কতটুকও এগিয়েছে জানা নেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্লব–পরবর্তী প্রশাসন গত ২৯ সেপ্টেম্বর একটি নতুন কমিটি গঠন করেছে।
১৫ তারিখের ঘটনা এতটা গুরুত্বপূর্ণ কেন? এ ঘটনা আওয়ামী সরকার পতনের আন্দোলন তরান্বিত করেছিল। গত ১৫ বছর রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের শত অত্যাচার সত্ত্বেও সামাজিক জনমত তৈরি করতে পারেনি। সরকার–সমর্থক গোষ্ঠীর আক্রমণে ১৫ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীরা নির্মম অত্যাচারের শিকার না হলে সরকার পতনের বিষয় সামনে আসতে পারত কি না, আমার সন্দেহ হয়।
১৫ তারিখ পর্যন্ত এই আন্দোলন ছিল কোটাসংশ্লিষ্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। ১৫ তারিখের পরে এটা হয়ে গেল ‘নিরাপদ ক্যাম্পাসে আমার মেয়েদের মারবে কেন’—সরকারবিরোধী আন্দোলন। সরকার হত্যাযজ্ঞে সেই সময় লিপ্ত না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মেয়ে শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছিত করার জন্য যে সামাজিক ক্ষোভ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল, তা সামাল দিতে পারত না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পরিচয়ের কারণে এই আন্দোলনের মানসিক ও সামাজিক আবেগ দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক আবেদনের সঙ্গে মিশে গিয়ে এক নতুন ক্ষোভের বাংলাদেশ তৈরি করত। ভাগ্য ভালো যে এত দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। আবার ভাগ্য খারাপ, কারণ এই আন্দোলনের পরিক্রমায় সরকারের দ্রুত পতনের জন্য অনেক রক্ত দিতে হলো।
১৫ জুলাইয়ের ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের তোফাজ্জল হত্যা যুক্ত হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডটি অত্যন্ত নির্মম, পীড়াদায়ক ও মর্মান্তিক। বৈষম্যবিরোধীদের ব্যাপক সাফল্যের পর এই ক্যাম্পাসে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সবাইকে মর্মাহত করেছে। এ ক্ষেত্রে বিচারের আহ্বান এড়িয়ে না গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ সবার মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি করেছে। আশা করছি, ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই দ্রুত বিচারের মুখোমুখি হবে। তবে নিপীড়নের শিকার এই ব্যক্তিকে কেন আহত অবস্থায় উদ্ধার করা গেল না—এই প্রশ্নটা এখনো গুরুত্বপূর্ণ। এটা কি ক্রিমিনালাইজেশন অব পলিটিকসের মাধ্যমে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার।
আমাদের রাজনৈতিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যও যে ব্যাধিগ্রস্ত, এই হত্যাকাণ্ড আমাদের এটা আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এ জন্য ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ে টেকসই শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে যেকোনো নির্যাতন ও নিপীড়নের ক্ষেত্রে প্রিএমটিভ মেজারস কীভাবে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে বেশ ভাবতে হবে। হত্যাকাণ্ড ঘটার পর বিচারের ব্যবস্থা যেন প্রয়োজন না হয়, আগেই যেন তাকে উদ্ধার করা যায়, সেইটাই এখন দরকার।