চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস–সংলগ্ন মাঠে কোনো রকম স্থাপনা না করার দাবি জানিয়েছে সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন। মাঠটি উন্মুক্ত রেখে ওখানে সবুজ বাগান গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে তারা গত বুধবার (২ অক্টোবর) মানববন্ধন করেছে। তাদের এই দাবিতে চট্টগ্রাম নগরের সচেতন মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। শুধু পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন নয়, পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামও এই দাবি জানিয়ে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে।
১৯১৩ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত সার্কিট হাউসটি নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। এই সার্কিট হাউস ভবনের চারপাশের প্রায় চার একর এলাকা ছিল উন্মুক্ত। কোনো ধরনের স্থাপনা ছিল না। এখন যেখানে স্টেডিয়াম আর আউটার স্টেডিয়াম, দক্ষিণের সুইমিংপুল, মার্কেট এবং বিদ্যুৎ দপ্তর—সবটা জুড়ে ছিল বিশাল মাঠ—বলা যায় তেপান্তরের মাঠ। ওখানেই চারটি দল অন্তত খেলতে পারত। উত্তর-পশ্চিমে রাস্তার পর সদ্য অপসারণ করা শিশুপার্কের জায়গায় ছিল খোলা মাঠ, যেখানে অন্তত দুটি দলের খেলা চলত।
বর্তমানে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর, মানে তখনকার সার্কিট হাউসের ভেতরেও একটি মাঠ ছিল, মাঝেমধ্যে ওখানেও তরুণেরা ফুটবল খেলতেন। অন্য মাঠে ফুটবল-ক্রিকেট—দুটিই চলত। সার্কিট হাউস আর চট্টগ্রাম ক্লাবের মাঝখানেও ছিল একটি মাঠ। চারপাশের খোলা প্রান্তরের মধ্যে দৃষ্টিনন্দন সার্কিট হাউসটিকে অতিকায় ক্যানভাসে একটি নিখুঁত শিল্পকর্মের মতোই লাগত।
যুগ যুগ ধরে চট্টগ্রামের নাগরিকেরা এই সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন এবং এখানকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে একটি উন্মুক্ত নাগরিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছেন। খোলা চত্বরের পাশে বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থার দপ্তর ও সাবেক বিভাগীয় স্টেডিয়াম এবং সুবিশাল আউটার স্টেডিয়াম। ফলে এলাকাটি হয়ে ওঠে কিশোর–তরুণদের খেলাধুলার প্রাণকেন্দ্র।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস ও স্টেডিয়াম এলাকায় প্রতিদিন হাজারো মানুষের জমায়েত হতো। পরিবেশ থাকত উৎসবমুখর। কিন্তু নগরের অন্য সব খোলা সবুজ প্রান্তর, পুকুর, দিঘি, খালের মতো এই এলাকার প্রান্তরও সংকীর্ণ হয়ে গেল। সার্কিট হাউসের নান্দনিক সৌন্দর্যের পটভূমি বিবেচনা না করেই মাঠে গড়ে তোলা হলো শিশুপার্ক, স্টেডিয়াম–সংলগ্ন এলাকায় গড়ে তোলা হলো শত শত দোকানপাট, আউটার স্টেডিয়ামকে সংকুচিত করে বানানো হলো বিশাল বিপণিকেন্দ্র ও অকেজো সুইমিংপুল।
মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এসব স্থাপনা হয়েছে গুটিকয় মানুষের স্বার্থের কথা চিন্তা করে। তাতে এলাকার সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে, সার্কিট হাউসের মতো ঐতিহাসিক স্থাপত্যশৈলীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে, কিশোর–তরুণদের খেলার সুবিধা কমে গেছে।
এমনিতেই চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে কয়েকটি স্কুল ছাড়া খোলা প্রান্তর তেমন আর চোখে পড়ে না। দিন দিন মাঠগুলোর জায়গা দখল করেছে অট্টালিকা ও স্বার্থান্বেষী মহলের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। মাঠ নিশ্চিহ্ন করার আগে নগরজীবনের মানুষের আবশ্যিক চাহিদার কথা এতটুকু বিবেচনায় আনা হয়নি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও উন্নয়নের কারণে শহরে খোলা মাঠ ক্রমেই বিলীন হয়ে পড়েছে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের নেতারা জানান, নানা কারণে চট্টগ্রাম শহর দিন দিন বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হচ্ছে। ইউরোপের বার্সেলোনায় ১০১ দশমিক ৯ বর্গকিলোমিটার আয়তন ও ৫৪ দশমিক ৭ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে মাথাপিছু উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ৫ দশমিক ৬ বর্গমিটার। প্রতিবেশী ভারতে কলকাতায় ১৮৭ বর্গকিলোমিটার আয়তন ও ৪৬ দশমিক শূন্য লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে মাথাপিছু উন্মুক্ত স্থান রয়েছে শূন্য দশমিক ৬৭ বর্গমিটার। অথচ ১৬৮ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ৫২ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে উন্মুক্ত স্থান আছে মাত্র শূন্য দশমিক ১৮ বর্গমিটার। সেই হাতে গোনা অল্প কটি উন্মুক্ত স্থানও বারবার নানা অপরিকল্পিত ও অপ–উন্নয়নে বিনষ্ট হওয়ার সম্মুখীন হচ্ছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন মাঠে নেমেছে সার্কিট হাউসের মাঠ থেকে অপসারণ করা শিশুপার্কের জায়গায় আর কোনো স্থাপনা না করার দাবিতে।