বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে উদ্ভূত গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসনের অবসানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, ছাত্র-তরুণদের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে এই নতুন বাংলাদেশ। কিন্তু নতুন বাংলাদেশের রূপ ঠিক কেমন হবে এবং তার রূপায়ণ ঘটবে কীভাবে, এর কোনো কিছুই যেহেতু আগে থেকে ঠিক করা নেই, তাই নানা ক্ষেত্রে সংস্কার, এমনকি নতুন করে তৈরির প্রশ্ন উঠেছে। তবে সুদিনের জন্য অপেক্ষা দীর্ঘ হতে থাকলে মানুষ যে খুব দ্রুতই ধৈর্য হারাতে পারে, সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাই সরকারের মধ্যে কোনো দ্বিধা বা দোদুল্যমানতার আলামত মোটেও কাম্য নয়।
নির্বাচনের আগে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একধরনের ঐকমত্য তৈরি হলেও সংস্কারের প্রক্রিয়াগত বিষয়গুলো নিয়ে মতভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন সমন্বয় কমিটি বাতিলের ঘটনা এর একটা বড় নজির। সংস্কার কমিশনগুলো গঠনের ঘোষণা পিছিয়ে দেওয়ার পেছনেও রাজনৈতিক চাপই মুখ্য বলে ইঙ্গিত মিলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে আলোচনার কথা বলা হয়েছে, সেই আলোচনাও মূলত সংস্কার সম্পর্কে নয়, বরং কমিশনের সদস্য ও কার্যপরিধি সম্পর্কে মতামত নেওয়াই এর মূল উদ্দেশ্য বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
পাঠ্যসূচি পরিমার্জন ও সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটি কাজ শুরু করার পর কমিটির দুজন সদস্যকে ইসলামবিদ্বেষী অভিহিত করে তাঁদের বাদ দেওয়া এবং আলেমদের অন্তর্ভুক্তির দাবি ওঠায় সরকার সেই কমিটি বাতিল করে দেয়। শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠ্যসূচি তৈরিতে ইসলামপন্থীদের প্রভাব খাটানোর বিষয়টি অবশ্য নতুন কিছু নয়; বরং তাদের চাপের মুখে আপস করায় আওয়ামী লীগ সরকারের রেকর্ড বিস্ময়কর।
মূলধারার শিক্ষাসূচির পাঠ্যবই থেকে অমুসলিম লেখকদের লেখা বাদ দেওয়া, দর্শন ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কথিত অনৈসলামিক দর্শন পরিহারের কথা এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যায়। মাদ্রাসাশিক্ষার প্রসারেও শেখ হাসিনার নির্বাচনী রাজনীতি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। কওমি পাঠ্যসূচিতে সরকারকে কোনো ভূমিকা না রাখতে দিলেও তাদের সনদগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যেই ২০১৮ সালের নৈশ ভোটের নির্বাচনের দুই দিন আগে মাদ্রাসাশিক্ষকদের সম্মেলন থেকে শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেওয়া হয়।
সরকার যে কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকুক না কেন, সাধারণভাবে ধারণা তৈরি হয় যে ইসলামপন্থীদের চাপের মুখে সরকার নতিস্বীকার করেছে। যৌক্তিক সমালোচনা উঠেছে, ভিন্নমতের কারণে দুই বিশিষ্টজনের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন ধর্মবিদ্বেষের অভিযোগ সরকার মেনে নিয়েছে। এই পটভূমিতে পূর্বঘোষিত সংস্কার কমিশনগুলোর সরকারি আদেশ জারির বিষয়টি পিছিয়ে দেওয়া নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়া তাই মোটেও অযৌক্তিক নয়।
স্বৈরাচারী শাসন অবসানের আন্দোলনের কৃতিত্ব দাবি নিয়ে সৃষ্ট অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক হচ্ছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষায় বিভক্তি উসকে দেওয়ার আরেকটি উদ্বেগজনক উদাহরণ। আন্দোলনের কেন্দ্রে ছাত্রদের যে যৌথ নেতৃত্ব ছিল, তাঁরা সবাই অকপটে স্বীকার করেন যে আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষ যুক্ত না হলে আন্দোলন তার সফল পরিণতি পেত না। আন্দোলনের সংগঠকদের অন্যতম মাহফুজ আলম প্রথম আলোকে বলেছেন, ১ থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত তাঁরা সেই অর্থে কোনো রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থনও পাননি। তিনি জানিয়েছেন, তাঁরা ভাবছিলেন আন্দোলনকে কীভাবে ২০২৬ সালে ছাত্র-নাগরিক আন্দোলনে পরিণত করা যায়।
বাংলা ব্লকেড কর্মসূচিতে জনমানুষের অংশগ্রহণ দেখেই তাঁরা আন্দোলনে সাধারণ মানুষের একাত্মতা উপলব্ধি করেছেন। আন্দোলনে তখন থেকে সব শ্রেণি-পেশার সক্রিয় অংশগ্রহণ ঘটে। মাহফুজ আলম এই আন্দোলনের আগে ২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলনের কথা যেমন স্মরণ করেছেন, তেমনি স্বীকার করেছেন গত ১৫ বছরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ সংগ্রাম ও নিপীড়িত হওয়ার ইতিহাস। অর্থাৎ অতীতের রাজনৈতিক আন্দোলন সফল না হলেও নির্যাতন-নিপীড়ন সয়েও তারা সংগ্রাম অব্যাহত রাখায় যে স্বৈরশাসনবিরোধী অভ্যুত্থানের একটি উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল, সেই বাস্তবতাও উপেক্ষণীয় নয়।
জামায়াতের সহযোগী ছাত্রশিবিরের নেতারা পরিচয় গোপন রেখে ছাত্রলীগ করতেন এবং পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে কয়েকজনের দাবি নিয়ে যে বিতর্ক দেখা গেল, তা-ও কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের লক্ষ্য থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়ার কোনো অভিসন্ধি যে এ বিতর্কের পেছনে নেই, তা কি জোর দিয়ে বলা যাবে? অতীতে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছিলেন বলে পরে প্রকাশ পেয়েছে। অনেক দিন ধরেই আওয়ামী লীগের নেতারাও বলে আসছিলেন যে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা তাঁদের দলে ঢুকে পড়েছে; যদিও তখন তা কেউ বিশ্বাস করেনি। বরং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন অপকর্মের দায় এড়ানোর অপকৌশল হিসেবে ওই সব অজুহাত দিত।
স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যেসব হামলা হয়েছে, তা সে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে হোক, আর ব্যক্তিগত রেষারেষি বা ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণেই হোক, রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুতই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তবে তারপরও কিছু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো ও মাজারে হামলার মতো অপরাধ সংঘটিত করেছে। স্বৈরশাসকের অপরাধের সহযোগী হওয়ার কারণে আত্মবিশ্বাস হারানো পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় এসব গোষ্ঠী তাদের অপতৎপরতা চালানোর সুযোগ নিয়েছে।