ঘৃণা, গণ-আন্দোলন ও ক্লেদের প্রবাহ
প্রথম আলোর উপসম্পাদক এ কে এম জাকারয়িা তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে গায়ক জন লেলনকে উদ্বৃত্ত করে লিখেছেন, ‘তুমি যা বোঝো না, তা ঘৃণা কোরো না’ (ডেন্ট হেইট হোয়াট ইউ ডেন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড) চারদিকে এত ঘৃণা, এত অশ্রদ্ধা ও এত প্রত্যাখ্যান ভাবা যায় না। তবে কী ঘৃণার্সবস্ব কথকতার খনি হয়ে উঠছে বাংলাদেশ? গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী শুভ্রতার বিপরীতে চলছে ঘৃণার চাষ। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ যথাযথ শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘ঘৃণাজীবী’ । ঘৃণা অবলম্বনে যাদের বাড়বাড়ন্ত।
গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী এক গতানুগতিক দিনের স্বপ্ন
অভ্যুত্থানের মর্মবাণী আমরা হজম করতে পারছি কি না, তা নিয়ে সংশয় জাগছে। প্রখ্যাত লেখক ইয়ুভেল নোয়া হারারি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রথম ধর্মযুদ্ধ শেষ হয়েছে, যুদ্ধে প্রচুর হতাহত হয়েছে, মানুষ অবরুদ্ধ ছিল। প্রতিপক্ষ যেদিন জেরুজালেম দখল করল, যুদ্ধ শেষ হলো, তার পরের দিনটি ছিল একদম গতানুগতিক। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণে দেখা যাচ্ছে, সকালে মানুষ ঘুম থেকে উঠছে, নাশতা করছে, তর্ক-বিতর্ক করছে, তাদের পেটব্যথা করছে। হারারি চমৎকারভাবে ধর্মযুদ্ধ–পরবর্তী এক স্বাভাবিক দিনের বর্ণনা তুলে ধরেছেন।
গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী এমন এক গতানুগতিক দিনের আকাঙ্ক্ষা ছিল। অভ্যুত্থান–পরবর্তী শোক থাকবে, দ্রোহ থাকবে, কিন্তু উন্মাদনা থাকবে না। আমাদের গণ-অভ্যুত্থান হয়ে উঠছে বিরতিহীন এক টানাটানির নাম। গজিয়ে ওঠা নানা পক্ষ ক্লেদের পেরেক বসাচ্ছে। জনস্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থ মুখ্য হয়ে উঠছে। আর বিভক্তির জন্য আশ্রয় নিতে হচ্ছে ঘৃণার চাদরের নিচে।
স্বজনসংলগ্ন জীবন ও বিভক্তির রাজনীতি
স্বজনসংলগ্ন জীবন আমাদের। পরিবারের ভেতর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। রাজনীতির কারণে ঘরগুলোতে উঠছে সীমানাপ্রাচীর। ঘৃণা বা ক্লেদ ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কে সৃষ্টি করছে তীব্র বিভক্তি। এসব প্রাচীর সরানোর কোনো রাস্তা কী নির্মাণ করা যাচ্ছে? এত বিভক্তি নিয়ে কতদূর এগোবে সমাজ?
জানি জনমনে ক্ষোভ রয়েছে, ঘৃণা রয়েছে, মর্মবেদনা রয়েছে। এগুলো পেছনে ফেলে পরিশীলন নিয়ে এগোতে হবে। বিজয়োল্লাস বা কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে শুভবোধ হবে সংযুক্তির জিয়নকাঠি। বিজয়ের পর আর কোনো বিজয় থাকতে পারে না। বড় বিজয়ের নিচে ছোট বিজয়ও কাম্য নয়।
বাংলাদেশ বিনির্মিত হোক স্বয়ংভু ধারায়
ঘৃণা চাষের অযোগ্য। অথচ তার রমরমা চাষ চলছে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নে সবাই কণ্ঠ মিলিয়েছিল। সেখান থেকে সরে এখন বিভিন্ন দিক থেকে নানা রকমের দাবি তোলা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম দুটি ধারা হলো, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ; অন্যটি হলো, ইসলামিক মূল্যবোধ সংযোজিত বাংলাদেশ। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ইসলামপন্থা। ধর্ম, নারীর পোশাক, মাজার, জনপরিসরে চলাফেরা, রাজনৈতিক বিশ্বাস, নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ঘিরে নতুন মাত্রায় বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে, উসকে দেওয়া হচ্ছে সহিংসতা। পাঠ্যক্রম সংশোধন নিয়ে বিশেষ ধরনের গোষ্ঠীপনা লক্ষ করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ বিনির্মিত হোক স্বয়ংভূ ধারায়। যদিও গণ-অভ্যুত্থানকে তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা ও কর্মকৌশল নির্ধারণে সংকট দেখা যাচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থান, বিপ্লব ও সংস্কার গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। এ গণ-আন্দোলন যদি জাতির স্বতন্ত্র পরিচয় নির্মাণ করতে পারে, তা হবে চূড়ান্ত অর্জন। ভাষাভিত্তিক বা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার বাইরে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মধ্যে স্বতন্ত্র পরিচয় নির্মাণে বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার পরিচয় দিতে হবে।
যাহোক, শুরু কথায় ফিরে আসি, ‘তুমি যা বোঝো না, তা ঘৃণা কোরো না’—জন লেলন এ কথার গভীরতা রয়েছে। কোনো ঘটনা, বিষয় বা প্রপঞ্চ বুঝতে পারলে ঘৃণা উদ্রেক হওয়ার কথা নয়। কারণ, প্রকৃতি হলো রূপ, রং, রস, আকার, বিন্যাসে ভরা সত্তা। প্রকৃতির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য বৈচিত্র্য, গতি ও নিরপেক্ষতা। সৃষ্টির অনুগামী হলে মৌলনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সৃষ্টিকর্তা বৈচিত্র্যময় সত্তা। হাজারো গুণের সমষ্টি। তার ব্যাকরণে ঘৃণা বলে কিছু নেই। এ দেশের মানুষের বৈচিত্র্যজাত, রক্তে সংকর আর চেতনায় যৌগিক।