অচিরেই সাইবার নিরাপত্তা আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে—আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল যেদিন (২৯ সেপ্টেম্বর) এই কথা বললেন, তার পরদিনই আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এই আইনে দায়ের হওয়া স্পিচ অফেন্স সম্পর্কিত মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাছাড়া এসব মামলায় কেউ গ্রেপ্তার থাকলে তিনিও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি পাবেন।
সরকারি তথ্য বলছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর অধীনে গত আগস্ট পর্যন্ত দেশের আটটি সাইবার ট্রাইব্যুনালে পাঁচ হাজার ৮১৮টি মামলা চলমান। এর মধ্যে 'স্পিচ অফেন্স' সম্পর্কিত মামলার সংখ্যা এক হাজার ৩৪০টি।
অতীতের সরকারগুলোর সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একটি মৌলিক পার্থক্য দেখা যাচ্ছে এই যে, একসময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল আইন বা সাইবার আইনে কতগুলো মামলা হয়েছে, কতটার বিচার চলছে, কতটা মামলায় চার্জশিট হয়েছে—এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া খুব কঠিন ছিল। এমনকি কোনো কোনো সাংবাদিক তথ্য অধিকার আইন কাজে লাগিয়েও তথ্য পাননি। অথচ এখন সরকারের তরফে স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলার সংখ্যা ও বিস্তারিত জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে তথ্যের অবাধ প্রবাহের কোনো বিকল্প নেই। যখনই কোনো প্রতিষ্ঠান তথ্য লুকিয়ে রাখতে চাইবে, তথ্য দিতে গড়িমশি করবে; তথ্য সমন্বিত আকারে নেই, পরে যোগাযোগ করুন—ইত্যাদি টালবাহানা করবে, তখনই বুঝতে হবে 'ডাল মে কুছ কালা হ্যায়'। বছরের পর বছর ধরে সরকারি অফিসগুলো এভাবে 'কুছ কালা' থিওরিতে চলেছে। এখানে বড় ধরনের সংস্কার লাগবে। টাকার গায়ে যেমন লেখা থাকে 'চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে'—সরকারি অফিসেও নাগরিকের তথ্য প্রাপ্তির বিষয়টি এতই সহজ করতে হবে যে, তথ্যদাতারা যেন বোঝেন চাহিবামাত্রই তারা তথ্য দিতে বাধ্য থাকবেন (রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যক্তিগত গোপনীয় বাদে)।
ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তমত প্রকাশের কারণে দায়ের হওয়া মামলাগুলোকে 'স্পিচ অফেন্স' এবং কম্পিউটার হ্যাকিং বা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে জালিয়াতিকে 'কম্পিউটার অফেন্স' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আইন মন্ত্রণালয় বলছে, সাইবার নিরাপত্তাসম্পর্কিত তিনটি আইনে দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে বর্তমানে স্পিচ অফেন্স সম্পর্কিত এক হাজার ৩৪০টি মামলার মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অধীনে ২৭৯টি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে ৭৮৬টি এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলার সংখ্যা ২৭৫টি।
সরকার মূলত স্পিচ অফেন্স সম্পর্কিত মামলাগুলোর মধ্যে বিচারাধীন ৮৭৯টি মামলা আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্রুত প্রত্যাহার করতে চায়। আর তদন্তাধীন ৪৬১টি মামলা চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিলের মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, এসব মামলায় কেউ গ্রেপ্তার থাকলে তিনি এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি পাবেন।
নিশ্চয়ই এটি অন্তর্বর্তী সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কেননা, বিগত দিন তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং সবশেষ সাইবার নিরাপত্তা আইনে যেসব মামলা হয়েছে, তার অধিকাংশই ছিল হয়রানিমূলক এবং কিছু ব্যতিক্রম বাদে ক্ষমতাবানদের সুরক্ষিত রাখতে যেকোনো ধরনের ভিন্নমত দমনই ছিল এইসব মামলার উদ্দেশ্য।
বছরের পর বছর ধরে এই তিনটি আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে যে পারসেপশন তৈরি হয়েছে তা মোটামুটি এই যে, এই আইনগুলো ডিজিটাল দুনিয়ার নাগরিকের সুরক্ষার কথা বলে তৈরি করা হলেও আদতে এর উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাকে প্রশ্নহীন রাখা। যে কারণে গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পরে জনসপরিসরে যেসব দাবি বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হয়েছে, তার অন্যতম সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল অথবা এর যৌক্তিক সংশোধন। বিশেষ করে এটি এমনভাবে সংশোধন করতে হবে যাতে কেউ চাইলেই এটিকে প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে।
বাস্তবতা হলো, এই আইনগুলোয় নাগরিকদের যাতে সহজেই হয়রানি করা যায় সেজন্য অপরাধের সংজ্ঞায় সচেতনভাবেই একধরনের অস্পষ্টতা তৈরি করে রাখা হয়েছে। যেমন: ধর্মীয় অনুভূতি বলতে কী বুঝায়, কী লিখলে কারো ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হবে, ধর্মীয় বিষয়ে কেউ যদি এমন কিছু লেখেন, যেটি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে বলে মনে হতে পারে, সেটি কে ঠিক করবে?