রাষ্ট্র সংস্কারের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্প্রতি কমিশন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্য কিছু বড় বিষয়েও শ্বেতপত্র; পর্যালোচনা ও করণীয় নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জটিল ও বহুমাত্রিক শিক্ষা খাত ও উপ খাত চালু রাখার জন্য বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে।
শিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজনের কথা বলা হলেও সামগ্রিক সংস্কার বা পরিবর্তনের উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ২৫ আগস্টে তাঁর প্রথম ভাষণে শিক্ষা নিয়ে চারটি বিষয় উল্লেখ করেন। এগুলো হচ্ছে পূর্ববর্তী সরকারের অপশাসনে শিক্ষাব্যবস্থা পঙ্গু হওয়া, অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষার ব্যাপক সংস্কারে অঙ্গীকার, পরিবর্তিত সময়ের জন্য যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম তৈরি করা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালু করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের এখন প্রয়োজন ন্যূনতম সংস্কার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা এবং কোথা থেকে কাজ শুরু হবে, তা স্থির করা। এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে রাজনৈতিক সংলাপ থেকে।
জরাজীর্ণ শিক্ষা
২০১০ সালে একটি জনসমর্থিত শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল সব শিশুর জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিদ্যালয়ের ধরন নির্বিশেষে এক মূল অভিন্ন শিক্ষাক্রম এবং সব বিদ্যালয়ের পাঠদান ও অবকাঠামোর গ্রহণযোগ্য মান নিশ্চিত করা। সে উদ্দেশ্যে পরিকল্পনাও আছে এই নীতিতে। এই পরিকল্পনার কেন্দ্রে ছিল শিক্ষক, শিক্ষার-শিক্ষক অনুপাত, শিক্ষাব্যবস্থার ও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা, অংশগ্রহণ ও জবাবদিহি ইত্যাদি। লক্ষ্য বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রসঙ্গ আছে সেখানে। কিন্তু গত দেড় দশকের এসব কাজের জন্য কোনো সমন্বিত ও সামগ্রিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
উন্নয়ন যা হয়েছে, তা কেবল সংখ্যাগত। প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাবে এবং ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহির দুর্বলতায় গুণগত ফল অর্জিত হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেও শিশুদের অর্ধেকের বেশি মৌলিক সাক্ষরতা ও গণিতের দক্ষতা দেখাতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ শিক্ষা-দারিদ্র্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার দর্শন, লক্ষ্য ও উন্নয়ন কৌশলের দুর্বলতায় এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের অভাব শিক্ষাকে ক্লিষ্ট করে রেখেছে। তাই শিক্ষায় উন্নয়ন প্রচেষ্টা আংশিক, খণ্ডিত এবং রোগের মূলে না গিয়ে উপসর্গের চিকিৎসা বলে পর্যালোচকেরা মনে করেন।
২০২২ সাল থেকে নতুন বিদ্যালয় শিক্ষাক্রম চালু করার উদ্যোগ এবং শিক্ষার্থী মূল্যায়নের বড় পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এটি ছিল খণ্ডিত, আনুষঙ্গিক সবকিছু বিবেচনা না করে বিদ্যালয়ের ও শিক্ষকদের প্রস্তুতি ও সক্ষমতার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। এই উদ্যোগ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে প্রবল উদ্বেগ ও শঙ্কা সৃষ্টি করে।
প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষার সব খাত ও উপ খাত ধরলে শিক্ষার আয়োজনের সঙ্গে দেশের ১৭ কোটি মানুষের বেশির ভাগ নানাভাবে যুক্ত। শিক্ষার ব্যাপারে আছে তাদের নিজস্ব প্রত্যাশা ও মতামত। তাই সবার আশা পূরণ করে, শিক্ষার সংস্কারে এগিয়ে যাওয়া দুরূহ।
আশু পদক্ষেপ
অতীতের অনাচার এড়িয়ে শিক্ষাব্যবস্থা কার্যকরভাবে চালু রাখার জন্য নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন। এর জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ কালক্ষেপণ না করেই নেওয়া জরুরি।
১. নতুন স্বাভাবিকের সূচনা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘নতুন স্বাভাবিক’ পরিবেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষার্থী-শিক্ষার্থী সম্পর্কে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহিষ্ণুতা নিশ্চিত করতে হবে। শান্তি বিঘ্নকারী, আধিপত্য, চাঁদাবাজির পরিবেশ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করতে হবে। এ জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্টদের সংলাপের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২. গ্রহণযোগ্য কার্যকর নিয়োগের নীতি নির্ধারণ: এই নীতিতে নিয়োগ ও পদায়নে শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষা ও শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের যোগ্যতা হবে একমাত্র মাপকাঠি। এ জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া নির্ধারণ করতে হবে আলোচনার মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার আগপর্যন্ত যত নিয়োগ ও পদায়ন হবে, সেগুলো স্বল্পমেয়াদি বা অস্থায়ী বলে বিবেচিত হবে।
৩. নির্বাচিত ছাত্র সংসদ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা: সব উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ প্রবর্তন করতে হবে।
৪. আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত না নেওয়া: শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অবাস্তবায়নযোগ্য নতুন বিদ্যালয় শিক্ষাক্রম স্থগিত করা হয়েছে। তবে বিগত সরকারের সব উদ্যোগ বাতিল বা পরিত্যাগ যুক্তিযুক্ত নয়। নবম শ্রেণি থেকে বিশেষায়িত ধারা পুনঃপ্রবর্তনও যুক্তিসংগত নয়। তেমনি সব নতুন পাঠ্যপুস্তক সম্পূর্ণ বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। এগুলোর কিছু সংশোধন করে ব্যবহার করা যেতে পারে।