নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের সার্ক বা দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে যে সহযোগিতার সমিতি গড়ে উঠেছিল সাতের দশকের শেষ ও আটের দশকের গোড়ায়, সেই সমিতির সংক্ষিপ্ত বা এব্রিবিয়েশন হচ্ছে SAARC (সার্ক)। ওই আঞ্চলিক সহযোগিতার সমিতিটির পুনরুজ্জীবন চান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এখন আমেরিকার নিউ ইয়র্কে। জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য গেছেন। কিন্তু জাতিসংঘের ওই অধিবেশনের বাইরে, যাকে সবাই বলে সাইড লাইনে বেশ কিছু মিটিং হয় বিশ্বনেতাদের সঙ্গে, পারস্পরিক বিষয়-আশয় নিয়ে। সেই আলোচনায় তারা চান ওইসব নেতার সমর্থন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং অন্য বিষয়েও তারা মতবিনিময় করেন।
এটা একটি প্রচলিত ধারা। বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসও সহযোগিতা চেয়েছেন। এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তিনি কিছু চাওয়ার আগেই তারা মানে বিশ্বনেতারা তাকে সহযোগিতা করার কথা জানান। এবং তিনি যেন ওই সম্মেলনের প্রধান একজন, এরকম একটি সম্মান পাচ্ছেন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ড. ইউনূসের যে উষ্ণ ও আন্তরিক মিটিং বিশ্ববাসী দেখেছে এবং আমরা তার অংশীজন হিসেবে যে গৌরবের ভাগ পেলাম, তা সত্যিকার অর্থেই জাতির কাছে অভাবনীয় ছিল। একটি ছোট দেশের সরকারের উপদেষ্টামাত্র তিনি, কিন্তু বিশ্ব দরবারে তার গ্রহণযোগ্যতা যে উচ্চতায় তা আমাদের বিস্মিত করেছে।
এটা যে আমাদের ধ্বংসপ্রায় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা টেনে তোলার একটি বিপুল চেষ্টা, তাই যেন অনুভব করলাম। বিল ক্লিনটন, হিলারি ক্লিনটন ও কন্যা চেলসি ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত বন্ধু হয়ে উঠেছেন সেই কবে। সেই পুরোনো দিনের কথা বলতে বলতে ক্লিনটন ও ইউনূস লুকোচুরি খেলার মতো করে পরস্পরকে জড়িয়ে নিয়ে যে উষ্ণতার বান আনলেন, তাও বিরল। বিশ্বনেতারা তাকে বাংলাদেশের মতো একটি সংগ্রামশীল জনঅধ্যুষিত দেশের নেতা বলে মনে করেননি শুধু, তিনি যে ওই নেতাদেরই পরম বন্ধু, সেটাই তারা প্রমাণ করেছেন।
সাইড টেবিলে বসে কথা বলেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শরিফ নেওয়াজ। তারা দুজনই সার্কের পুনর্জন্ম চান। কিন্তু যে সাতটি দেশ এর মূল সদস্য, তাদের মধ্যে ভারত হচ্ছে সব থেকে বড় স্টেকহোল্ডার। গোটা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ম্যাপের দিকে তাকালে মনে হবে ভারতের চারপাশের ওই দেশগুলো যেন উপমহাদেশেরই গলার মালা।
সার্ক যে আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি, তার পুরো দায় ভারতের। কারণ ভারত সব সময় সব বিষয়ে যেমন চাইছে, তেমনি সার্কের ওপরও সে দাদাগিরি চাপাতে চেষ্টা করেছে। পরিণামে তা খারাপ ফল দিয়েছে। এই সূত্রে ওই অনন্য চেতনার সার্ক টুটে গেছে। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি পরস্পর থেকে সহযোগিতার যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহ সৃষ্টি হয়েছিল, একটি ঐক্য ও বিশ্বাসের ভিত সৃষ্টি হয়েছিল, তা নস্যাৎ হয়ে গিছে। পরস্পরের মধ্যে যে বন্ধুত্ব ও সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়ন ও কল্যাণকে কেন্দ্রবিন্দু করা হয়েছিল, সেই প্রবাহটি ধূলিসাৎ করেছে ভারত, একাই।
মালদ্বীপ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এতটাই শীতল যেটা অনেকটাই ঘৃণার স্তরে পৌঁছে গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ লাগে কাশ্মিরকে নিয়ে, কারগিল নিয়ে তার একটি। আমাদের ওপর নানারকম অন্যায় করে ভারত প্রমাণ করেছে দেশটি বাংলাদেশের বন্ধু নয়। তাদের কূটনৈতিক ভাষা যতই পোলাইট হোক না কেন, সীমান্তে বাংলাদেশিদের ওপর গুলি করে হত্যা করতে দ্বিধা করে না। নিরস্ত্র এবং ক্ষেতের চাষা বা তাদেরই সন্তান কাজ করতে গেলেও ওপার থেকে বিএসএফ গুলি চালিয়ে হত্যা করে। এবং হত্যাই বিএসএফের প্রধান নেশা। এ কারণে এ দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ ভারতবিরোধী। শুধু আওয়ামী লীগ ভারতের প্রেমে হাবুডুবু খায়। উৎখাত হওয়ার পর হাসিনা প্রমাণ করেছেন যে তাকে পালাতে হবে ভারতেই। শেখ হাসিনা পালায় না- বলে যে দম্ভ করেছিলেন, সেই তিনিই পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন দিল্লিতে।
ফলে সার্কের উত্থান সহজ হবে না বলেই মনে করি আমি। ভারত ছাড়া আর দেশগুলো চাইলেও নরেন্দ্র মোদীর অনুমোদন পাবে না সার্ক। তবে, ভারতের আক্কেল দাঁত উঠলেই কেবল সে জিয়ার স্বপ্ন ও এরশাদের সার্বিক সহযোগিতায় সার্কের প্রথম অধিবেশনটি ঢাকায় হয়েছিল, ভারতের মনন-চেতনায় এরকম কোনো উদ্ভাবনী সহযোগিতার দৃষ্টান্ত নেই বলে তারা সার্ককে আন্তরিকভাবে মেনে নিতে পারেনি।