‘আমাদের লোক’ হওয়ার সুফল আমলারা বুঝে গেছেন—এই শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি কলাম লিখেছিলেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার। তিনি নিজে একসময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। ওই কলামে তিনি লিখেছেন, ‘ইউএনও, এসি ল্যান্ড, ওসি থেকে থানার দারোগা, পিআইওসহ সব ক্ষেত্রেই “আমাদের লোক” চান রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি বড় অংশ। এটা অনেকটা প্রথা হয়ে গেছে। ফলে মাঠ প্রশাসনে অনেকটাই ভেঙে পড়েছে চেইন অব কমান্ড।’
আলী ইমাম মজুমদার আরও লিখেছেন, ‘১৯৯১ সালে গণতন্ত্রায়ণের পর থেকে সব রাজনৈতিক সরকার নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিতে বরাবর “আমাদের লোক” তত্ত্ব বহাল রেখেছে। আর দিন দিন ভারী হচ্ছে তা। “আমাদের লোক” হওয়ার সুফল প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা টের পেয়ে গেছেন। তাই একটি অংশ নিজ থেকেই সরকারদলীয় লোকের মতো আচরণ করছে।’
আলী ইমাম মজুমদার এই লেখা লিখেছিলেন ২০২১ সালের ১ জুলাই। এর প্রায় তিন বছর পর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচলন করা ‘আমাদের লোক’–এর প্রথা ভাঙার দায়িত্ব অনেকটাই তাঁর ওপর এসেছে পড়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে রাজনৈতিক সরকারগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রশাসনে ‘আমাদের লোক’ তৈরির যে উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে, কোনো সন্দেহ নেই গত ১৫ বছরে তা সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এ সময়ে ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থাও চরম স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে রূপ নেয়।
সেই স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে। সরকারের পতন প্রশাসনের পতন ঘটায় না। দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করা স্বৈরশাসকের ‘আমাদের লোকেরা’ প্রশাসনজুড়েই ছড়িয়ে আছেন। মার্কামারা কয়েকজন অবশ্য পালাতে বাধ্য হয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এখন দেশ চালাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে স্বৈরাচারী সরকারের ‘আমাদের লোক’ বাদ দিয়ে প্রশাসন চালানোর এত লোক তাঁরা কই পাবেন?
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব আকবর আলি খানের গ্রেশাম’স ল সিনড্রোম অ্যান্ড বিয়ন্ড, অ্যান অ্যানালাইসিস অব দ্য বাংলাদেশ ব্যুরোক্রেসি বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালে। জনপ্রশাসনের একই পরিস্থিতির বর্ণনা পাওয়া যায় সেখানেও। তিনি লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের হাতেই এখন জনপ্রশাসনে পদোন্নতি ও বদলি হচ্ছে। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা ধ্বংস হয়ে গেছে, ভালো মানের জনসেবা দেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ আম্পায়ার হিসেবে তার আর বিশ্বস্ত নয়।’ বোঝা যায়, আমলাতন্ত্রের পরিস্থিতি এক দিনে এই জায়গায় আসেনি। সব রাজনৈতিক সরকারগুলোই এর জন্য দায়ী।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর সচিবালয় ও মাঠ প্রশাসনের পরিস্থিতি নিয়ে দুজন জ্যেষ্ঠ আমলার মন্তব্য ছাপা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, গত আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ করেছে, তা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। এই অনিয়মের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনের সব স্তরে একধরনের অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার লিখেছে, রাজনৈতিক কারণে বা যোগ্যতা-দক্ষতার অভাবে যাঁরা পদোন্নতি পাননি, যাঁরা পদোন্নতি পেয়েছেন কিন্তু পছন্দের জায়গায় নিয়োগ পাননি, অথবা ভালো পদে আছেন কিন্তু দুর্বল পারফরম্যান্সের জন্য বড় পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন—এমন সব পক্ষই সরকার পতনের পর সচিবালয়ে একযোগে বিশৃঙ্খলা শুরু করে। নাম প্রকাশ না করে একজন সচিব পত্রিকাটিকে বলেছেন, ‘আমার ২৯ বছরের চাকরিজীবনে আমি এমন পরিস্থিতি দেখিনি, এটা অবিশ্বাস্য যে সচিবালয়ের বিসিএস ক্যাডাররা এ ধরনের আচরণ করতে পারে।’
আসলে গত ১৫ বছর যে মাত্রায় দলীয়করণ ও যোগ্যতাকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি ও নিয়োগ হয়েছে—সচিবালয়ের এই নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা তারই অনিবার্য পরিণতি। এটাও আমাদের দেখতে হয়েছে যে জনপ্রশাসনের কোনো কোনো কর্মকর্তা দলীয় কর্মীর মতো সরকার পতনের পর পালিয়ে গেছেন, অফিসে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। আর এই সুযোগে সেই কর্মকর্তাদের রুমে গিয়ে দখল কায়েম করার উদ্যোগও নিয়েছেন কিছু কর্মকর্তা।
প্রশাসনে এত দিন ‘আমাদের লোক’ হিসেবে যাঁরা কাজ করেছেন, তার বাইরে ছিলেন কিছু ‘তাঁদের লোক’। দীর্ঘদিন কোণঠাসা অবস্থায় থাকা এই লোকেরা এখন মাঠ দখলে নেমেছেন। ব্যাপারটি অনেকটা আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপির লোকজনের বাজার বা বাসস্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার মতোই। একদিকে প্রশাসনের সবখানে ছড়িয়ে আছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ‘আমাদের’ লোক, অন্যদিকে মাঠ দখলে নেমেছেন ‘বঞ্চিত’ হিসেবে বিবেচিত ‘তাঁদের’ লোকেরা। প্রশাসন সাজানো বা রদবদলের কাজটি তাই সহজ হচ্ছে না।
এমন একটি জটিল ও কঠিন বাস্তবতায় দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে রদবদলের উদ্যোগ নেয়। অনেক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল হয়েছে, আবার অবসর থেকে ফিরিয়ে এনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দেওয়া হয়েছে, কাউকে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে অনেক কর্মকর্তাকে। মাঠপর্যায়ে অনেক ডিসিকে প্রত্যাহার ও নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।