কয়েক দশকে বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। বিশেষ করে এক দশকে, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি লক্ষ্য করা গেছে। এর মূল কারণ হিসেবে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করা হয়।
এই প্রেক্ষাপটে, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাম্প্রতিক বৈঠক নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে, যা যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের এক নতুন মাত্রা হিসেবে ধরা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন বৈঠক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জোসেফ আর বাইডেনের সাথে, যা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৯তম অধিবেশনের সাইডলাইনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে এক নতুন মাত্রায় উন্নীত করতে চলেছে।
ইউনূস-বাইডেন বৈঠকের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে আগস্ট ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। যদিও প্রথমদিকে সরকারের কিছু উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে, সময়ের সাথে সাথে সরকারের প্রতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
বিরোধী দলের ওপর দমনমূলক পদক্ষেপ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর রিপোর্ট প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে থাকে।যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার, স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এর ফলে, এক দশকে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্যে একটি শীতলতা দেখা যায়।
ড. ইউনূস ২০০৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এবং বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটি বৈশ্বিক মঞ্চ যেখানে বিশ্বের নেতারা বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন। ড. ইউনূসের বৈঠক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সাথে দুই দেশের ভবিষ্যৎ সহযোগিতার নতুন দিকনির্দেশনা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক : চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা
জো বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার এবং বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ড. ইউনূসের সঙ্গে বাইডেনের বৈঠক এই নীতিরই প্রতিফলন। ড. ইউনূস বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের কাছে তথ্য প্রদান করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই বৈঠক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবে গণ্য হতে পারে। এই বৈঠকের মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসন স্পষ্টভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি একটি বার্তা পাঠাচ্ছে যে, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আপস করবে না। এছাড়া এটি ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্বদের ভূমিকাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।
ড. ইউনূস ও বাইডেনের এই বৈঠক একদিকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপরেও প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে যদি বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শীতল হতে পারে।
একইসঙ্গে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করতে পারে যদি তারা সুশাসন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে ড. ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নেতাদের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অর্থনীতি কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে গেলেও বৈশ্বিক বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোর একটি, বিশেষত তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে। তবে শ্রমিকদের অধিকার এবং নিরাপত্তার প্রশ্নে বারবার যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। বাইডেন প্রশাসন শ্রম অধিকার এবং ন্যায্য বাণিজ্যের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে।