রক্তাক্ত দীঘিনালা ও কর্তৃত্ববাদী প্রকৌশল

সমকাল পাভেল পার্থ প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৪৪

লুটতরাজ ও দখলে উন্মত্ত রেজিম চুরমার হলো কেন? কারণ রেজিম জনতার আওয়াজ পাঠ করেনি। গলি, গালি, পাহাড়, সমতল, বাজার, বাগান, দেয়াল কি দরগা, রাজপথ কি ময়দান, উদ্যান কি উড়ালপথ, জনতার জমতে থাকা ফিসফাস, আহাজারি, ক্রোধ কি প্রলাপ পাত্তা দেয়নি প্রবল কর্তৃত্ববাদ।


জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেশজুড়ে জেন-জির আঁকা গ্রাফিতি। জুলাইয়ের বেশ কিছু সিগনেচার-গ্রাফিতির মধ্যে রয়েছে–রাষ্ট্র সংস্কার, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-আদিবাসী আমরা সবাই বাংলাদেশ, পানি লাগবে পানি, ৩৬ জুলাই, বুক পেতেছি গুলি কর, কল্পনা চাকমা কোথায় কিংবা পাহাড়ে কবে মুক্তি মিলবে? জুলাই গণঅভ্যুত্থান বেশ জোরালোভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং আদিবাসী জীবনের বঞ্চনা-বৈষম্যকে সামনে এনেছে। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার কি ছাত্র-জনতার এসব গ্রাফিতিকে আমলে নিয়েছে? জনআকাঙ্ক্ষা ও জিজ্ঞাসাকে গুরুত্ব দিচ্ছে? ৩৬ জুলাইয়ের পরেও পাহাড় ও আদিবাসী জনপদে প্রশ্নহীনভাবে জারি থাকা কর্তৃত্ব ও ‘মব ট্রায়াল’ দেখে তা মনে হচ্ছে না।


ঢাকা কি চট্টগ্রামজুড়ে জেন-জি সবাইকে নিয়ে কত গ্রাফিতি আঁকল। অনুমতি নিতে থানা-পুলিশ করতে হলো না। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্রাফিতি আঁকার ক্ষেত্রেও অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতাকে সেনা ক্যাম্পের অনুমোদন নেওয়ার খবর প্রকাশিত হলো। ৩৬ জুলাইয়ের পর কিছু আদিবাসী বসতিতে হামলার ঘটনাকে আমরা ভেবেছিলাম মব ট্রায়াল বা বিচ্ছিন্ন উচ্ছৃঙ্খল তৎপরতা। কিন্তু ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে যা ঘটল, তা কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন বা অনৈতিহাসিক কোনো ঘটনা নয়। কর্তৃত্ববাদী বাঙালি জাত্যাভিমানের পুনরাবৃত্তি। একটি রেজিম ভেঙেছে বলে রাষ্ট্রের মনোজাগতিক অপরায়ণ ডিসকোর্স বদলে যায়নি। প্রতিদিন বহু দীঘিনালা ঘটার সমস্ত রসদ ও রসনা সবই আমাদের মগজ ও মাস্তানিতে রয়ে গেছে। রেজিম বদলালেও আদিবাসী জগৎ নিয়ে জাতিবাদী বাইনারি বিভাজনের রাজনীতি বদলায়নি।


জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে-পরে কত মিডিয়া কতভাবে চোখের সামনে মুখোশ ও মেকআপ পাল্টাল। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আদিবাসী ইস্যুতে অনেক মিডিয়া সেই একই বাহাদুরি মর্জি ও মনস্তত্ত্ব জারি রাখল। এমনকি দীঘিনালার সাম্প্রতিক ঘটনায় বহু মিডিয়া সকল ঐতিহাসিকতাকে বরাবরের মতোই আড়াল করে লিখল, এটি ‘পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ’। যদি বাইনারি ‘সংঘর্ষই’ হয়ে থাকে, তবে কেবল আদিবাসীদের ঘর অঙ্গার হয় কেন কিংবা কেন আদিবাসীরাই গুলিবিদ্ধ হন? আর কতকাল পার্বত্য চট্টগ্রাম ডিসকোর্সে নির্দয়ভাবে পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় বর্গকে অনৈতিহাসিক করে রাখা হবে? পাহাড়ের আদিবাসী ও সেটলার বাঙালিরা কি কোনো ইউটোপীয় মঞ্চের পুতুল কিংবা সিনেমার মুখস্থ স্ক্রিপ্ট–যেন এই উভয় বর্গের একমাত্র কাজ হচ্ছে সংঘর্ষ ও হামলায় জড়িয়ে পড়া! একতরফাভাবে কেবল পাহাড়ি-বাঙালি বাইনারি বিভাজন দিয়ে আর সব জীবন্ত ও প্রবল কর্তৃত্ব কোনোভাবেই গোপন রাখা সম্ভব না। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এসব বাইনারিকে প্রশ্ন করেছে।



গোপনীয়তার গরাদ ভেঙে পাহাড়ের মুক্তিবার্তার গ্রাফিতি এঁকেছে। তো এই মুক্তিবার্তাকে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাষ্ট্র কীভাবে পাঠ করবে? পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্নে সংবিধান এবং সংস্কার কী হবে? এসব মৌলিক জিজ্ঞাসাকে আড়াল করে, লোক দেখানো কোনো প্রলেপ পুনরাবৃত্তি হলে পাহাড়ের মুক্তি মিলবে না।


পাবর্ত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জীবনে জারি থাকা সকল অন্যায় এবং নিপীড়নের সঙ্গে বাঙালি রাষ্ট্রের জাত্যাভিমান, সামরিক বাহাদুরি, করপোরেট ট্যুরিজম, পাহাড় দখল, মনোকালচার, কাপ্তাই বাঁধ, জনমিতি-প্রকৌশল, নিওলিবারেল ক্ষমতা, দলবাজি রাজনীতি বহু কিছু নানাভাবে জড়িয়ে আছে। এসব বহুস্তরীয় ক্ষমতাবলয় চুরমার না হলে দীঘিনালায় কোনো দিন অঙ্গার আর রক্তস্রোত বন্ধ হবে না।


আদিবাসী আত্মপরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, ভূমি কমিশন, পার্বত্য চুক্তি, সেনাশাসন, বায়োপাইরেসি, অপরায়ণ, ভয়ের সংস্কৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০, বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয়ক্ষতি, স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্ক, প্রথাগত অধিকার কিংবা মাতৃভাষার সুরক্ষা–এমন মৌলিক প্রসঙ্গগুলো দাবিয়ে রেখে বা কোনো মীমাংসায় না এনে রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কার হতে পারে না। কী নিদারুণ!


জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক মাস না যেতেই, মাটিতে রক্তের কাঁচা দাগ না শুকাতেই আমরা ইনক্লুশনকে অস্বীকার করছি, বরং পতিত রেজিমের বাইনারি বিভাজন দিয়ে জনতার বিরুদ্ধে জনতাকেই প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাখছি। আমরা কোনোভাবেই ছাত্র-জনতার তুমুল শক্তি ও সাহসের ওপর আস্থা হারাতে চাই না। হয়তো পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক ঘটনায় তদন্ত কমিশন হবে, নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ন্যায়বিচার পাবে, অপরাধীদের শাস্তি হবে। বিশ্বাস করি, আগের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত প্রতিটি অন্যায়ের মতো দীঘিনালার সাম্প্রতিক হামলা ও সংঘাত বিচারহীন থাকবে না।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us