গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের বিদায় এবং অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণেরও তই তই করে এক মাস পেরিয়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের বদল হয়েছে দেশজুড়েই। চলছে আলোচনা-বিশ্লেষণ আর ভবিষ্যতের রূপরেখা ও অঙ্গীকার। কাঙ্ক্ষিতভাবেই নতুন সরকার গঠনের পর বেশ কিছুদিন চলেছে পদত্যাগের হিড়িক। কেউ নিজ থেকে পদত্যাগ করেছেন, কেউ কেউ বাধ্য হয়েছেন। শূন্য পদে নতুন নিয়োগও হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বেশির ভাগ শূন্য পদ ইতোমধ্যেই পূরণ হয়েছে।
নিয়োগ নিয়ে জনপরিসরে বড় ধরনের প্রতিবাদ না হলেও আলোচনা-সমালোচনা চলছে অনলাইন বা অফলাইনে। কারণ সবার প্রত্যাশা ছিল, গণঅভ্যুত্থানের মূল প্রেরণা প্রাপ্যতা, ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীনতা নতুন নিয়োগগুলোর ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হবে। কারণ দলীয় নিয়োগের ফলে অসীম ক্ষমতা চর্চায় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে পাশ কাটিয়ে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রেও পুরোনো বৈশিষ্ট্যই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে। যেন শুধু ব্যক্তি পরিবর্তিত হচ্ছে। এমনকি কয়েকটি ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগকৃতরা সকাল-বিকেলে প্রমোশনও পাচ্ছেন।
বেশির ভাগ নিয়োগের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে বিদায়ী দলের লোকজনকে সরিয়ে যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তারাও অন্য কোনো দলের প্রতি অনুগত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তালিকা থেকেই মূলত নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। দলীয় পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এলাকাপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি, বলয়প্রীতি। এখন অনেকে ছাত্রনেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন; তাদের মাধ্যমে নিয়োগকর্তাদের কাছে পৌঁছাতে। রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও
তদবির চলছে।
প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে বাংলাদেশে বারবার অভ্যুত্থান হলেও সংস্কারের পথ কি এ রকমই? এর থেকে আমাদের কোনোভাবেই কি মুক্তি নেই? বিষয়টি এমন নয়, রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য থাকলে কিংবা নির্দিষ্ট এলাকার বাসিন্দা হলেই কেউ অযোগ্য হয়ে যাবেন কিংবা যোগ্য স্বজনদের নেওয়া যাবে না। বিষয়টি একেবারেই পদ্ধতিগত; নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহির প্রশ্ন। কী পদ্ধতি অবলম্বনে নিয়োগগুলো হচ্ছে, সেটি জানার অধিকারও নিশ্চয়ই জনগণের আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রেও রদবদল আগের নিয়মেই চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখা গেছে বিদায়ী রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত ও পদত্যাগকারী প্রক্টর, ডিন ও প্রাধ্যক্ষদের স্থানে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ক্ষমতা আরোহণের সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত শিক্ষকদের। মনে হচ্ছে এক সেট গিয়ে আরেক সেট বসেছে। যেহেতু এগুলো অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য, সে ক্ষেত্রে উপাচার্যরা কিছু মানদণ্ড অনুসরণ করে নিয়োগ দিতে পারতেন। যেমন ডিনদের ক্ষেত্রে হতে পারত অনুষদগুলোর সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের এই দায়িত্ব দেওয়া। তাতে হয়তো প্রশাসকরা ‘যেই লাউ সেই কদু’ অপবাদ থেকে বাঁচতেন। কিন্তু আমরা বিদায়ী সরকারের মতো একই ধরনের ছবিই দেখতে পাচ্ছি।
এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, কী প্রক্রিয়ায় নিয়োগগুলো সম্পন্ন হচ্ছে? কী কী মানদণ্ডকে সামনে রেখে নিয়োগ কর্তারা তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন? কিংবা নিয়োগের ক্ষেত্রে আদৌ কি মানদণ্ড তৈরি করেছেন? রাজনৈতিক দলই যদি প্রাধান্য পায় তাহলে তো আগের নিয়মই থাকল!
হতে পারে, নিয়োগের ক্ষেত্রে গণঅভ্যুত্থানের ভূমিকাও নিশ্চয়ই বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। তাহলে তো আগের আমলের মতোই মেধা ও যোগ্যতার বদলে ‘পুরস্কৃত’ করার চর্চা রয়ে গেল! বিশ্বাস করতে চাই, এ সরকার আগের কর্তৃত্ববাদী সরকারের মতো ব্যক্তিগত পছন্দ কিংবা নিজের ঘরানার বা দলকানা লোকদের নিয়োগ দেবে না বা দিচ্ছে না। তাহলে কী কী বিবেচনা বা মানদণ্ডকে সামনে রেখে এ নিয়োগগুলো হচ্ছে, সেই স্বচ্ছতা থাকা খুব প্রয়োজন। নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি কোনো ধরনের মানদণ্ড না মানা হয় তাহলে তো আসলে আমরা একই জায়গায় থমকে আছি।
কেন আমাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে জানতে হবে? সেটি নিয়ে নতুন মানদণ্ড তৈরি করতে হবে? কারণ আমরা জেনে গেছি, বুঝে গেছি ব্যক্তি বদলই রাষ্ট্র বদল করতে পারবে না। এর জন্য একেবারেই প্রয়োজন পদ্ধতিগত সংস্কার। এর আগেও আমরা দেখেছি প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তি খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ ব্যক্তির ‘নিরপেক্ষ’ হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। আর ‘নিরপেক্ষ’ লোক দিলেই যে তিনি নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেন না, সেটির প্রমাণ তো আমরা আগেও দেখেছি। দরকার প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা। সেই নিরপেক্ষতা তৈরি এবং সচল রাখার প্রধান নিয়ামকই হলো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা। কারণ প্রাপ্যতা, ন্যায্যতা, জবাবদিহি আর সুশাসনও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। সেটিই যদি না থাকে তাহলে তো প্রতিষ্ঠানগুলোর আর বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না।