৮ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের এক খবরে বলা হয়েছে, পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের জন্য দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে, সেগুলো স্রেফ অপচয় করা হয়েছে। কারণ, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ওই চ্যানেলের গভীরতা ১০.৫ মিটারে উন্নীত করার এক মাসের মধ্যেই পলি পড়ে গভীরতা আবার ৭ মিটারে নেমে এসেছে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পটি সমাপ্ত হয়েছিল ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট, আর এক মাস না পেরোতেই সাড়ে ৩ মিটার গভীরতা হ্রাস পেয়েছে চ্যানেলের। দেশের নেতৃস্থানীয় প্রকৌশলী প্রফেসর আইনুন নিশাত মত ব্যক্ত করেছেন, পায়রা নদের যে বিপুল পলিবহন প্রবণতা রয়েছে, সেটা বিবেচনায় নিলে প্রতিবছর রাবনাবাদ চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রয়োজন হবে, নয়তো পায়রা বন্দর সমুদ্রবন্দর থাকবে না, একটা নদীবন্দরে পরিণত হয়ে যাবে। তাঁর মতে, পায়রা কখনোই ভালো সমুদ্রবন্দর হতে পারবে না, গভীর সমুদ্রবন্দর তো দূরের কথা। কোনো বন্দর-চ্যানেলের কমপক্ষে সাড়ে ৮ মিটার গভীরতা না থাকলে ওই চ্যানেলে সমুদ্রগামী জাহাজ প্রবেশ করতে পারে না। ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল দুটি জাতীয় দৈনিকে আমার প্রকাশিত কলামে আমি একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু হাসিনা সরকার সেটাকে পাত্তাই দেয়নি। আমার ওই কলামের হুবহু বক্তব্য আমি নিচে তুলে ধরছি।
‘২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে পায়রা বন্দরের নৌপথের পলির বিপদ সম্পর্কে জার্মানির বিশ্বখ্যাত ভূতাত্ত্বিক প্রফেসর হারম্যান কুদরাসের নেতৃত্বাধীন পাঁচজন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান গবেষকের একটি টিমের গবেষণা প্রতিবেদনের বক্তব্যগুলো প্রকাশিত হয়েছে, যেটা বাংলাদেশের জনগণের জানা উচিত মনে করি এবং বিষয়টি নিয়ে সরকারেরও গভীর পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি ২০১৯ সালের ১১-১২ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপিত হয়েছিল। প্রফেসর কুদরাস জার্মান সরকারের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান ছিলেন, বর্তমানে জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। গবেষণা দলের অন্য চার সদস্য হলেন বেলজিয়ামের জেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মেয়ের, জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পালমেনাচি, জার্মানির হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ম্যাচালেট এবং বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর হুমায়ুন আখতার। প্রফেসর কুদরাস ২০ বছর ধরে বঙ্গোপসাগরের পলি ও পানির প্রবাহ নিয়ে গবেষণা করছেন। ২০১২ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশ যখন মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অন ল’জ অব দ্য সিজ (ইটলস) এবং হল্যান্ডের দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে আইনি লড়াই চালিয়ে বিজয় অর্জন করেছিল, তখন প্রফেসর কুদরাস ওই মামলাগুলোতে বাংলাদেশের দুজন পরামর্শকের অন্যতম ছিলেন।
পায়রা বন্দর সম্পর্কিত তাঁদের গবেষণার মূল বক্তব্য হলো, পায়রা এলাকায় সমুদ্রবন্দর করা হলে সারা বছর ওই বন্দরকে পলিমুক্ত রাখা প্রচণ্ড ব্যয়বহুল হবে। কারণ, বিশ্বের যতগুলো উপকূলীয় এলাকা আছে, তার মধ্যে পটুয়াখালীর পায়রা এলাকায় সবচেয়ে বেশি পলি জমা হয়। পায়রা নদীর ওই চ্যানেল দিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৪০ কোটি কিউবিক মিটার পলি প্রবাহিত হওয়ায় জোয়ার-ভাটায় এক বছরের মধ্যেই বারবার চ্যানেলটি ভরাট হয়ে যাবে। একবার ভরাট হলে খনন করতে ৮-১০ হাজার কোটি টাকা লাগবে, যে ব্যয় নিয়মিতভাবে বহন করা যেকোনো দেশের জন্যই বিশাল বোঝা। গবেষণা অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগর থেকে পায়রা বন্দরে ভিড়তে হলে একটি জাহাজকে ৬০ কিলোমিটার নৌপথ পাড়ি দিতে হবে। ওই পথের ২৪ কিলোমিটারে ৫ মিটার, ২২ কিলোমিটারে ১০ মিটার এবং ১৪ কিলোমিটারে ১৫ মিটার গভীরতা রয়েছে। বড় জাহাজ চলাচল নির্বিঘ্ন করতে যেহেতু এই রাবনাবাদ নৌপথটিতে ১৫ মিটার গভীরতা ও ৩০০ মিটার প্রস্থ থাকতে হবে, তাই প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ কোটি কিউবিক মিটার পলি খননের প্রয়োজন হবে, যার খরচ পড়বে ৮-১০ হাজার কোটি টাকা। আরও বিপজ্জনক হলো, একটা বড়সড় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হলে বিপুল পলি পড়ে নৌপথটি একেবারেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যার অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে ভয়াবহ। গবেষকদের স্থির সিদ্ধান্ত হলো, পায়রা বন্দরকে সংবৎসর চালু রাখা বাংলাদেশের জন্য একটি মহা-অপচয়মূলক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এসব বক্তব্যের সারকথা হলো, পায়রা বন্দর কখনোই একটি যৌক্তিক ব্যয়ের “গভীর সমুদ্রবন্দর” হবে না।
‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, কয়লা আমদানি এবং এলএনজি আমদানির জন্য মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে জাপান অর্থায়নে সম্মত হয়েছে। মাতারবাড়ীর সে বন্দরটি বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজন হয়তো কিছুটা মেটাবে, প্রধানত কয়লা ও এলএনজি আমদানির জন্য। কিন্তু মাতারবাড়ীতে সোনাদিয়ার মতো ১৫ মিটার গভীরতা পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে পটুয়াখালীতে পায়রা বন্দর গড়ে তোলার জন্য জোরেশোরে কাজ শুরু হয়েছে এবং চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব ফান্ড থেকে বন্দরটি গড়ে তোলার জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুতরাং পায়রা বন্দর এবং চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভারতের সেভেন সিস্টার্সের সমুদ্রের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের বন্দরসুবিধা ব্যবহারের প্রয়োজন বেশ কিছুটা মিটবে। শেখ হাসিনার নিজস্ব রাজনীতির প্রয়োজনে যেহেতু দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোর প্রতি তাঁর একটি বিশেষ দুর্বলতা থাকাই স্বাভাবিক, সেহেতু পায়রা বন্দরটি দ্রুতগতিতে গড়ে তোলা হচ্ছে। এমনকি এ রকমও বলা হচ্ছে, পায়রা বন্দর আঞ্চলিক গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজন মেটাবে। কিন্তু প্রথম থেকেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, পায়রা বন্দর গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজন মেটাবে বলে যে দাবি করা হচ্ছে তার কোনো ভিত্তি নেই। ওপরে বর্ণিত বিশ্বখ্যাত বিশেষজ্ঞদের গবেষণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে পায়রা বন্দর কখনোই একটি ব্যয়সাশ্রয়ী গভীর সমুদ্রবন্দর হতে পারবে না। এই বিষয়ে শেখ হাসিনার জেদাজেদি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি বড়সড় আর্থিক বোঝাই ডেকে আনছে। আল্লাহর ওয়াস্তে এই অপরিণামদর্শী ও মহা-অপচয়মূলক প্রকল্প পরিত্যাগ করুন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। দেশের আরেকটি সমুদ্রবন্দর হিসেবে পায়রা গড়ে উঠুক, কিন্তু গায়ের জোরে এটাকে “গভীর সমুদ্রবন্দর” বানাতে পারবেন না আপনি।’