প্রায় তিন সপ্তাহ পার হয়ে চতুর্থ সপ্তাহে পড়ল নোয়াখালীর বন্যা-পরবর্তী জলাবদ্ধতা। নতুন বৃষ্টিতে পরিস্থিতি এ সপ্তাহে আরও অসহনীয় হয়েছে। বিস্ময়করভাবে দেশের কেন্দ্র থেকে সেদিকে প্রতিকারমূলক নজর অপ্রতুল। বন্যার শুরুতে পানির আচমকা তুমুল বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ভারতীয় বাঁধের কথা বলা হয়। ত্রাণ তোলা ও বিতরণের এক গৌরবময় গণতরঙ্গও তৈরি হয়েছিল তখন। দু-চার দিন পরই উভয় ধারার উত্তেজনা থেমে গেছে।
মাঝে বৃষ্টি বন্ধ হলে পানি সামান্য একটু কমেছিল কিছু এলাকায়। এ সপ্তাহে পুনরায় বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা প্রায় আগের মাত্রায় চলে গেছে। পানি কেন কমছে না, কমানোর উপায় কী, সেসব বিষয়ে জাতীয় বা আঞ্চলিক পরিসরে কারও কোনো অর্থপূর্ণ অনুসন্ধান ও উদ্যোগ নেই আপাতত।
কয়েক সপ্তাহের জমা পানিতে ইতিমধ্যে নোয়াখালীর বহু এলাকায় গাছপালা পড়ে যাচ্ছে। কয়েক দশকে গড়ে তোলা রাস্তাঘাট নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। ফসলি জমি প্রায় স্থায়ী জলাশয় হয়েছে। গবাদিপশুগুলো খুব সস্তায় বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ। যাঁরা খামার বাঁচাতে পেরেছেন, তাঁরাও গরুর খাবারের জোগান দিতে গিয়ে মুশকিলে আছেন। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনের সুযোগ বলা যায় দীর্ঘস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। পশুখাদ্যের প্রাকৃতিক উৎস সামান্যই অবশিষ্ট আছে।
ক্ষতির ধরন এখানে বহুমাত্রিক। শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চেহারাও গেছে পাল্টে। সব মিলে এই অঞ্চলের মানুষ নিকট ইতিহাসে এত বড় বিপদে পড়েনি আর। জাতীয় অর্থনীতিতে নানাভাবে বিপুল অবদান রেখেও এ জেলার মানুষ নিজেদের খুবই উপেক্ষিত ভাবছে এই মুহূর্তে। ১০ লাখের বেশি মানুষ সরাসরি পানিবন্দী।
মানুষ ত্রাণ নয়, সমস্যার কাঠামোগত সমাধান চাইছে
শুরুতে অনেক ত্রাণ গেছে নোয়াখালীতে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যরাও ত্রাণ দিয়েছে। সরকারিভাবে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে দুই দফায় শতাধিকজনকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিত্যনতুন ইস্যু ও উত্তেজনার মুখে ত্রাণ তোলা এবং সেসব নোয়াখালীতে পাঠানোর আয়োজন এখন কম।
অন্যদিকে দুর্গত এলাকার চিত্র হলো সেখানে কিছু মানুষ নতুন করে ত্রাণকেন্দ্রে যেতে শুরু করলেও সমাজ ত্রাণের চেয়েও বেশি চাইছে পানি সরানোর উদ্যোগ। মাঝের দুই সপ্তাহে বৃষ্টি তেমন হয়নি—কিন্তু পানি কমেছিল সামান্যই। অর্থাৎ পানি নামার কোনো পথ নেই অনেক ইউনিয়নে। এতে গ্রামে গ্রামে সংকট বহুমুখী চেহারা নিয়েছে।
স্বাভাবিক অর্থনীতি তছনছ হয়ে গেছে। কিছু জিনিসপত্রের জোগানও চাহিদার তুলনায় কম। দুই হাজার টাকার নৌকা চট করে ছয় হাজার টাকা হয়ে গেছে। তরিতরকারির খুব দাম। নিচুতলার বড় জনগোষ্ঠী অটোরিকশা-সিএনজিচালক ও নির্মাণশ্রমিকদের হাতে একদম টাকা নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিপুল নির্মাণশ্রমিক থাকেন এই জেলায়। তাঁরা কর্মহীন হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কৃষির মধ্যে মৎস্য ও মুরগির খামারিরা প্রায় সবাই সর্বস্বান্ত। এ রকম স্থানীয় মানুষেরা বলছেন, গতানুগতিক ত্রাণে এ সমাজে স্বস্তি ফিরবে না। দ্রুত জলাবদ্ধতার নিরসনই মানুষকে স্বপুনর্বাসনের সুযোগ করে দিতে পারে। কিন্তু সে বিষয়ে জোরালো দাবি তোলার মতো রাজনীতি নেই, প্রশাসনিক উদ্যোগও সীমিত।