স্কুলজীবনে দুই লাইন কবিতা পড়েছিলাম, ‘অসুন্দরে নাশবি যদি/ গড়বি নব নন্দনে রে।’ এটি কার কবিতা, শিরোনামই–বা কী, তা এখন আর মনে পড়ছে না। কিন্তু সবাই বোঝেন, নতুন ভালো বাগান (নন্দন) সৃষ্টি করতে হলে বর্তমানে যা কিছু অসুন্দর, জঞ্জাল রয়েছে, তা নাশ (হত্যা) বা দূর করেই এগোতে হবে। আমাদের এই মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক সংস্থার চাকরির পরেই বেসরকারি করপোরেট সংস্থার চাকরি ছিল সবচেয়ে লোভনীয়।
কিন্তু ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের মতো ইদানীং সরকারি চাকরি আবার সে স্থানটি দখল করে নিয়েছে। অথচ এই সরকারি চাকরিতে শুধু বয়সের মারপ্যাঁচ কিছু অবিচার ও অসুন্দর হিসেবে শিকড় গেড়ে বসেছে।
চাকরিতে প্রবেশের বয়স
সরকারি চাকরিতে ‘প্রবেশের বয়স’ বিষয়টি দেশের তরুণদের কাছে অবিচার হিসেবে ধরা দিচ্ছে। পরিণামে তরুণ চাকরিপ্রত্যাশীরা এবার চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। তবে এই বয়সটি অত্যধিক বেশি। ৩৫ বছরে চাকরির বিজ্ঞপ্তি পেয়ে সাড়া দিলে এবং বয়স্কদের অভিজ্ঞতা আরও কিছুদিন কাজে লাগানোর চিন্তা থেকে সরকারি কর্ম কমিশনের অন্তত তিন বছর লাগবে পরীক্ষা নিয়ে চাকরি দিতে।
মানে, চাকরি শুরু হবে ৩৮ বছর বয়সে। চাকরি শেষের বয়স যৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে ৬০ বছর করা হলেও চাকরি করতে পারবে মাত্র ২২ বছর। যদিও এখন ২০ বছরের চাকরিই পূর্ণ পেনশনের যোগ্য, চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে একসময় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ছিল ২৫ বছর; স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু দিক থেকেই এই বয়স ২৭ বছরে উন্নীত করা হয়। ১৯৮০-এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজটের কারণে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ স্নাতক, বিশেষত স্নাতকোত্তর শিক্ষা ২৭ বছর বয়সের মধ্যে শেষ করতে পারছিল না।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছরের সামরিক-আধা সামরিক শাসনের পর নতুনভাবে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে এলে এ ধারার প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার বিষয়টি অনুধাবন করে ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স তিন বছর বাড়িয়ে ৩০ বছরে উন্নীত করে। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে দিনবদলের ধারায় চাকরিতে প্রবেশ ও অবসর—দুটির বয়সই বাড়ানোর জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। দেশে এখন পাবলিক-প্রাইভেট মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় দেড় শ।
এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েট হয়ে বেরিয়ে আসছে। চাকরির আক্রা বাজারে বিরাট প্রতিযোগিতা। তাদের তো প্রতিযোগিতা করার সুযোগ দিতে হবে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর পক্ষে কিছু যুক্তি হচ্ছে: ১. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে, কিন্তু কর্মসংস্থানের অভাবে প্রতিবছর বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা; ২. উচ্চশিক্ষার পাঠ্যসূচির সঙ্গে বিসিএসসহ চাকরির পরীক্ষা-কোর্সের বিস্তর পার্থক্য থাকায় তাদের আবার নতুন করে চাকরির পড়াশোনা করতে হয়; ৩. করোনাকালে প্রায় দুই বছর নিয়োগ শূন্যের কোঠায় নেমে গিয়েছিল; ৪. পরিণামে বেকারদের মনোবল ভেঙে গেছে বা যাচ্ছে।
এসব বিবেচনায় তরুণ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের মনোবল চাঙা করতে এবং তাদের আন্দোলন থামাতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়িয়ে দেওয়া হোক। বাড়ানোর পরিমাণ সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে। বিপুল আয়োজনে দেশমাতৃকার তরুণদের লেখাপড়া শিখিয়ে বয়সের মারপ্যাঁচে ফেলে বেকারত্বের গ্লানি উপহার দেওয়া তো কোনো কল্যাণকামী রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে না!
চাকরি থেকে অবসরের বয়স
সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বর্তমান বয়সটি অসুন্দর। এই অঞ্চলে একসময় চাকরি থেকে অবসরের বয়স ছিল ৫৫ বছর। দেশের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রায় শুরু থেকেই অবসরের বয়স ৫৭ বছর করা হয়। এ অবস্থা প্রায় ২০ বছর ধরে চলে। ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স একবারে তিন বছর বৃদ্ধির সাপেক্ষে অবসরের বয়সও তিন বছর বাড়ানোর যুক্তি মজবুত থাকলেও নতুন ধারার তৃতীয় গণতান্ত্রিক সরকার ২০০৯ সালে তা মাত্র দুই বছর বাড়িয়ে ৫৯ বছরে উন্নীত করে। এমন বয়সের প্রস্তাবকারী, পাসকারী ও বাস্তবায়নকারীদের আমি নাম দিয়েছি ‘ঊন-পছন্দ ব্যক্তিবর্গ’।
অবসরের বয়স বাড়ানোর আর বেশি যুক্তি পেশ করার দরকার আছে কি? তবু কয়েকটি লিখি: ১. স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৫২ বছর; ৫৩ বছরে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৩ বছর; ২. অকালে অবসরে যাওয়া এই মানুষগুলো সুস্থতার বিচারে আরও দীর্ঘদিন কর্মক্ষম থাকছেন, কিন্তু কর্ম পাচ্ছেন না (ফলে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার প্রচুর আশঙ্কা রয়েছে); ৩. সুস্থ-সবল দক্ষ ও অভিজ্ঞ এই মানুষগুলোর সেবা না নেওয়া জাতীয় অপচয়; ৪. কয়েকটি দেশে অবসরের বয়স (ভারতে ৬০ বছর, সুইজারল্যান্ড ও সুইডেনে ৬৫ বছর এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানে ৬৬ বছর) বাংলাদেশের এ বয়সের চেয়ে ঢের বেশি।