বাংলাদেশের মতো যেকোনো বিকাশমান অর্থনীতির চারটি স্তম্ভ হচ্ছে রপ্তানি, প্রবাসী আয়, বিদেশি সাহায্য আর বিদেশি বিনিয়োগ। আমি কয়েক দিন ধরে নতুন সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মডেলটি বোঝার চেষ্টা করছিলাম।
প্রাথমিক পর্যালোচনায় আমার মনে হয়েছে, সরকার চ্যালেঞ্জের বৈতরণি পার হওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালনের চেয়ে ‘ইউনূস গুডউইল’ ব্যবহার করে বিদেশি সাহায্যের জন্য অনেক বেশি মুখাপেক্ষী হয়ে আছে। হয়তো সে জন্যই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ও সংস্কারে অধিকসংখ্যক বিশ্বব্যাংক বা তদপর্যায়ের সাবেক কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে বা হচ্ছে। এতে খারাপ কিছু দেখি না, যদি না তাঁরা উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধির কাজে পুরোপুরি দাতাগোষ্ঠীর মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন এবং স্থানীয় পুঁজির সংবর্ধন প্রক্রিয়াকে অবহেলা করেন।
এ ক্ষেত্রে আমার ধারণা কিছুটা হলেও শক্তি পেয়েছে, যখন দেখছি সরকার এখনো ব্যবসা-বাণিজ্যকে সচল করার কাজে খুব একটা উঠেপড়ে লাগতে পারছে না কিংবা ব্যবসায় ও শিল্পাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সাফল্য দেখাতে পারছে না। অনেক জায়গায় শ্রমিকদের তাৎক্ষণিক বা নতুন নতুন দাবির কাছে সরকারকে নতজানু মনে হচ্ছে। এমনকি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কেও তারা আস্থায় আনতে পারছেন না বলে মনে হচ্ছে।
প্রথাগত ব্যবসাকে হঠাৎ করে সামাজিক ব্যবসায় রূপান্তর যে সম্ভব নয়, এটা বোধ হয় সবাই জানি। আমরা আরও জানি, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম মাধ্যম তৈরি পোশাকশিল্প খাত। তবে গত মাসের মাঝামাঝি থেকেই খাতটি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। পোশাকশিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের বিক্ষোভ নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভের জেরে শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আলোচনার ভিত্তিতে তা সমাধানও করা হয়েছে। কিন্তু এবার পোশাক খাতে শুধু নারী নয়, সমানসংখ্যক পুরুষ কর্মী নিয়োগ, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, হাজিরা বোনাস প্রদান এবং আন্দোলনকারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়াসহ ১১ দফা দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
এ আন্দোলন শিল্পাঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সরকার, শ্রমিক ও মালিকপক্ষ দফায় দফায় আলোচনা করেও এ খাতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারছে না। ফলে নিরাপত্তার অভাবে বাধ্য হয়ে মালিকপক্ষ সাধারণ ছুটিসহ অনির্দিষ্টকালের জন্য পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করছে। এ অস্থিতিশীলতার কারণে এ খাতের উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পোশাকশিল্পের মালিকেরা ক্রেতাদের চাহিদামতো যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না। ফলে ক্রেতারা তঁাদের ক্রয়াদেশ বাতিল করছেন। এরই মধ্যে ১৫-২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বাতিল করা হয়েছে। অথচ এ খাতে অস্থিতিশীল পরিবেশ দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়।
এ ধরনের অস্থিরতার কারণে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে এ খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ক্রেতারা যেহেতু তাঁদের স্টোরের শেলফ খালি রাখতে চান না, তাই সাময়িক হলেও অনেকটা বাধ্য হয়েই তাঁরা কিছু অর্ডার অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছেন। চলমান অস্থিরতা পোশাক খাতকে ধ্বংসের পাশাপাশি রপ্তানি আয়কে প্রভাবিত করছে, যা দেশের অর্থনীতিকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলছে।