আজ বাংলাদেশের স্বপ্ন একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার। দেশের জনগণের এই প্রত্যাশা নতুন নয়। নানা মাত্রিকতায় বৈষম্যের শিকার হয়েই বাঙালি জনগোষ্ঠী পাকিস্তান আমলে সংগ্রাম করেছে, আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছে এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে সামাজিক ন্যায্যতার প্রশ্ন, সমতার বিষয়, সাম্যের কথা বারবার উঠে এসেছে।
অসমতা ও বৈষম্যের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার লঙ্ঘন, সামাজিক ন্যায্যতার দলন ও অন্যায্য পক্ষপাত। অসমতা প্রতিফলিত হতে পারে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানসিক অঙ্গনে। বৈষম্য ঘটে ঘরে-বাইরে, দেশজ, আঞ্চলিক কিংবা বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে। অসমতা নিরীক্ষণ করতে কিংবা বৈষম্য নিরূপণে আমরা প্রায়ই ফলাফলের দিকে তাকাই যেমন—আয়বৈষম্য কিংবা সম্পদের অসমতা। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে যে বৈষম্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠেছে, সেটা হচ্ছে ‘সুযোগের বৈষম্য’ যেমন—শিক্ষায় কিংবা স্বাস্থ্যসেবায় অথবা তথ্যপ্রযুক্তিতে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে আয় ও সম্পদের অসমতা সর্বজনবিদিত। সত্যিকার অর্থে, এই অসমতা বোঝার জন্য উপাত্তের প্রয়োজন হয় না, ঢাকা শহরের পথে-ঘাটে বেরোলেই তা চোখে পড়ে। সেই সঙ্গে হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কিংবা অর্থ পাচারের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে অর্থ ও বিত্ত সামান্য কিছু মানুষ ও পরিবারে কুক্ষিগত। মোটাদাগের উপাত্তের দিকে যদি তাকাই, তাহলে আয়ের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের মোট আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ যেখানে দেশের নিম্নতম ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর যায়, সেখানে সমাজের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মানুষ ভোগ করে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ। ভোগের ক্ষেত্রে যেখানে নিম্নতম ১০ শতাংশ গৃহস্থালিতে মাসিক মাথাপিছু ব্যয় ২ হাজার ১২২ টাকা, সেখানে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ গৃহস্থালিতে সে সংখ্যাটি হচ্ছে ৯ হাজার ১৩৭ টাকা।
মানব উন্নয়নের নানা সূচকেও এমন বৈষম্য বিদ্যমান। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশু মৃত্যুর হার সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেখানে প্রতি হাজারে ৪৯, সেখানে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা প্রতি হাজারে ২৫। তেমনিভাবে, দেশের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ গৃহস্থালির ৮৫ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় প্রশিক্ষিত নার্সের হাতে। অন্যদিকে, নিম্নতম ২০ শতাংশ গৃহস্থালির মাত্র ৩২ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সের দ্বারা। আঞ্চলিক বৈষম্যের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যায়, বরিশালে সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫ শতাংশ, সিলেটে সেটা ৬০ শতাংশ। তেমনিভাবে পরিবেশ নাজুক জেলাগুলোতে বিভিন্ন পীড়ার প্রাদুর্ভাব অন্যান্য জেলার তুলনায় বেশি। এসব অঞ্চলে মোট গৃহস্থালির ৪৫ শতাংশই নানা পীড়ার শিকার।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুযোগে বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট। শিক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি ধারা, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম, বিত্তবান ও বিত্তহীনদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি প্রবণতার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগে একটি বিশাল বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে। দিনের পর দিন কোনো কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কোটা-ব্যবস্থা বজায় রেখে শিক্ষার সুযোগের ক্ষেত্রে অসমতা আরও বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এসবের প্রতিফলন ঘটেছে শিক্ষা অর্জনের ফলাফলে এবং তারপরে কর্ম নিয়োজনে। একইভাবে স্বাস্থ্য খাতে ত্রিধারা ব্যবস্থা বজায় রেখে স্বাস্থ্য সুযোগের ক্ষেত্রেও একটি বিশাল বৈষম্যের দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে।
ফলে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সেবার পরিমাণ যেমন অপ্রতুল, তেমনি তার মানও খুব নিচু। সাধারণ মানুষই সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যায় এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা ন্যূনতম স্বাস্থ্যসুবিধা পায় না। অন্যদিকে বিত্তবানেরা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়।
তথ্যপ্রযুক্তি সেবায় সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ গৃহস্থালির তিন-চতুর্থাংশের যেখানে আন্তর্যোগ সেবায় লভ্যতা আছে, সেখানে নিম্নতম ২০ শতাংশ গৃহস্থালির ক্ষেত্রে তুলনামূলক সংখ্যাটি হচ্ছে মাত্র ৯ শতাংশ। শহরাঞ্চলের ৫৫ শতাংশ মানুষ আন্তর্যোগ ব্যবহার করে, গ্রামাঞ্চলের তেমন মানুষের অনুপাত হচ্ছে ৩৫ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৩ শতাংশ ঘরে কম্পিউটার আছে এবং ৭৮ শতাংশ গ্রামীণ মানুষ যন্ত্রটি ব্যবহার করতে জানে না।
বাংলাদেশে নারী-পুরুষের মধ্যেও ফলাফল ও সুযোগের মধ্যে অসমতা রয়েছে। যেমন—উচ্চতম শিক্ষা স্তরে নারীর অন্তর্ভুক্তির হার যেখানে ১৭ শতাংশ, সেখানে পুরুষদের মধ্যে সেই সংখ্যা হচ্ছে ২৪ শতাংশ। দেশের শ্রমশক্তিতে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৮১ শতাংশ, নারীর মধ্যে সেই সংখ্যা হচ্ছে মাত্র ৩৬ শতাংশ। জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম স্তরের নির্বাহীদের মধ্যে নারীর অনুপাত হচ্ছে মাত্র ১২ শতাংশ। বাংলাদেশে মুঠোফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরুষ-নারীর মধ্যে ফারাক হচ্ছে ২৯ শতাংশ। আন্তর্যোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশের ৩৩ শতাংশ পুরুষ আন্তর্যোগ ব্যবহার করে, নারীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংখ্যা হচ্ছে ১৭ শতাংশ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও বৈষম্য অত্যন্ত গভীর—এই সত্য অতীত ও নিকট অতীতে বারবারই পরিলক্ষিত হয়েছে। যেকোনো রাজনৈতিক আলোচনা বা বিতর্কের জায়গাটি সরকারি দল কর্তৃক সম্পূর্ণভাবে দখল করে রাখে এবং বিরোধী দলের সব কর্মকাণ্ড নিষ্পেষিত হয়। প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে বিরোধীদলীয় প্রতিনিধিত্বের সুযোগ দেওয়া হয় না এবং সেই জায়গায় সরকারি দল একচ্ছত্রভাবে বিরাজ করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা যদি বলি, তাহলে সেখানে যেকোনো রকমের বিকল্প মতকে শায়েস্তা করেছে ক্ষমতাসীন দল। জ্ঞান ও শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ, অন্যান্য পেশাজীবী, সংবাদমাধ্যম, সুশীল সমাজের টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে।