নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় দেশের অর্থনীতিকে ভয়াবহ বিপর্যস্ত অবস্থায় পেয়েছে। ব্যাংক খাতে সংকট, ডলার সংকট, তারল্য সংকট, গ্রাহকের আস্থার সংকট, বাজারে সংকট, বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু মানুষের মূল্যবোধের সংকট-এক কথায় সর্বত্র সংকটের বিষয়েই আলোচনা হচ্ছে। এসব সংকট কাটিয়ে দেশের অর্থনীতির গতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কাজটি কঠিন। এখনো দেশের অর্থনীতির নতুন নতুন ক্ষতের কথা আমরা জানতে পারছি। এসব কঠিন চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানোর জন্যও সরকারকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হয়েছে।
বিগত সরকারের আমলে ১৫ বছরে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নানা মাত্রায় দলীয়করণ করা হয়েছে। প্রশাসনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নানারকম রদবদল করতে হচ্ছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে সেসব পরিবর্তনও করতে হচ্ছে। এদিকে দীর্ঘদিনের বঞ্চনার কারণে মানুষের মনে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল। সেই ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন দাবিতে মানুষকে সড়কে নামতে দেখা যাচ্ছে। এতে সড়কের শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে; জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। সম্প্রতি পোশাক শ্রমিকরাও বিভিন্ন দাবিতে সড়কে নেমেছেন। তাদের কোনো কোনো দাবির যৌক্তিকতা থাকলেও বহু দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। চলমান শ্রমিক অসন্তোষ কতটা উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড, সরকারকে এসব বিষয়েও সতর্ক থাকতে হচ্ছে।
সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপর স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় দেশের বিভিন্ন জেলায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত আকস্মিক এক ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে সরকারকে। বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনের দিকেও সরকারকে বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা লক্ষ করেছি, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এসব শীর্ষপদের শূন্যতা ইতোমধ্যে পূরণ করা হয়েছে এবং তা চলমান রয়েছে। বন্যা মোকাবিলাসহ আলোচিত সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে গিয়ে সরকারের পক্ষে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজের গতি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি এখন জোরালো হচ্ছে। আমরা জানি, অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে মনে রাখা দরকার, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আশার কথা হলো, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কার ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংক খাত এবং জ্বালানি খাতে গৃহীত কিছু পদক্ষেপের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হচ্ছে। বেশকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ পুনর্গঠনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতির বিবেচনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। ব্যাংক খাতে গ্রাহকের আস্থা ফেরানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপ (গ্রাহকের সঞ্চয়ের বিপরীতে বিমা স্কিম এক লাখ টাকার পরিবর্তে দুই লাখ টাকায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত) প্রশংসার দাবি রাখে। বিদ্যুৎ খাতেও ইতোমধ্যে গ্রাহকবান্ধব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের বহুল আলোচিত দায়মুক্তি আইন স্থগিত করা হয়েছে। এই আইনের আলোকে এ খাতে নতুন কোনো চুক্তি না করার সিদ্ধান্ত বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হচ্ছে। নির্বাহী আদেশের পরিবর্তে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের পুরোনো প্রক্রিয়ায় ফেরত যাওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক বলেই বিবেচিত হচ্ছে।
দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনের জন্য শ্বেতপত্র প্রকাশের লক্ষ্যে সরকার একটি কমিটি করেছে। এ কমিটি ইতোমধ্যে দুবার মিটিং করেছে। আশা করা যায়, কমিটি নির্ধারিত ৯০ দিনের মধ্যেই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে সক্ষম হবে। শ্বেতপত্রের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের কাছে স্পষ্ট হবে কী ধরনের উত্তরাধিকারের অর্থনীতিতে তাদের কাজ করতে হবে। সেই ভিত্তিভূমি নিরূপণ করাই শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির কাজ। শ্বেতপত্রে প্রধান কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করার কথা রয়েছে। যেহেতু শ্বেতপত্রে সামষ্টিক অর্থনীতির পাশাপাশি খাতওয়ারি পরিস্থিতিও পর্যালোচনা করা হবে, সেহেতু তা প্রকাশের পর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, ব্যাংকিং, কর আহরণ, অর্থ পাচার, মেগা প্রকল্প, দারিদ্র্য ও বৈষম্য-এসব বিষয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যাবে। আশা করা যায়, এসব তথ্য পরবর্তী সময়ে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে।
আমরা জানি, নতুন সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশকিছু কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। কমিটিগুলোর প্রতিবেদনের আলোকে সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা এটাও জানি, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নানারকম পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এসব কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি কিছু বিষয়ে সরকারকে এখনই জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বস্তুত মূল্যস্ফীতিজনিত সমস্যা সমাজের সব শ্রেণির মানুষের উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। তবে এ নিয়ে বেশি চিন্তিত স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষ। মূল্যস্ফীতি নিয়ে নানা তথ্য আমরা পেয়ে থাকি। জানা যায়, কখনো কখনো প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে মূল্যস্ফীতিজনিত প্রকৃত সমস্যা আরও ভয়াবহ। এসব বিবেচনায় নিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৪ শতাংশের কাছাকাছি। জানা গেছে, গত মাসে অর্থাৎ আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আগের মাসের তুলনায় কিছুটা কমেছে। আপাতদৃষ্টিতে এটি সুসংবাদ হলেও এতে বেশি আশ্বস্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আগের মাসের তুলনায় আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও এখনো খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ডাবল ডিজিটের উপরে। অর্থাৎ পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষ রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে।