শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এক মাসের বেশি সময় পেরিয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে আন্দোলন, দাবি এখনও চলমান; যদিও কিছু বিষয়ে একেবারে আওয়াজ নেই।
দেশে বিভিন্ন জায়গায় নারীর ওপর সহিংসতা হয়েছে, হচ্ছে। গণমাধ্যম ‘জ্ঞাত-অজ্ঞাত’ কারণে তা নিয়ে খুব বেশি সংবাদ প্রচার করছে না। কেন করছে না, এর যথাযথ কারণও জনসমক্ষে আসছে না। বলতে দ্বিধা নেই, এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকই হয়ে পড়েছে খবরের উৎস।
সমস্যা হচ্ছে, তথ্যের সূত্র ও সঠিকতা যাচাইয়ের সুযোগ নেই। অনেক ঘটনা এত ভয়াবহ যে ‘এমন ঘটতে পারে?’– এ প্রশ্ন করে অনেকেই হয়তো উড়িয়ে দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ফেসবুকেই লিখছেন, তাহলে এগুলো নিয়ে বাইরে কোনো ধরনের প্রতিবাদ বা আওয়াজ নেই কেন? নারী নেত্রী বা নারী সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদ করছে না কেন? কিন্তু ঘটনাগুলো ঘটছে, ফেসবুকে প্রতিবাদও হচ্ছে, যদিও নেওয়া হচ্ছে না প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিংবা উপদেষ্টা পরিষদ থেকেও জোরালো কোনো বক্তব্য আসছে না।
সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজারে নারী হেনস্তার বেশ কয়েকটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। একটি ভিডিও দেখে বোঝা যাচ্ছে ঘটনাটি রাতের। একদল লোকের ভিড়ে একজন নারী। তিনি কান ধরে উঠবস করছেন। আশপাশ থেকে বিভিন্নজন সেই নারীকে বাজে গালি দিচ্ছে। কেউ কেউ বলছে, ‘কান ধর...।’ শুধু তাই নয়, সেই নারীকে মারা হচ্ছে। একজন ব্যক্তি একটি কাঠের টুকরো দিয়ে সেই নারীকে বারবার আঘাত করছে। এই ভিডিওটিকে বিভিন্ন অংশে আনলাইনে পোস্ট করা হয়েছে। আরেকটি ভিডিওতে সেই হেনস্তার মবে নারীদেরও দেখা গেছে। সেই নারী জুতা হাতে মেয়েটিকে নানা প্রশ্ন করছে, জোর করে মেয়েটির মুখের মাস্ক খুলে ফেলেছে, তাঁকে গালি দিচ্ছে এবং ভিডিও ধারণ করেছে।
নিশ্চিতভাবে আরও অনেক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এমন আরেকটি ভিডিও থেকে দেখা যায়, সমুদ্রসৈকতে বিচ চেয়ারে বসা একজন নারী। সেখানে একদল যুবক হঠাৎ করে ঘিরে ফেলেছে তাঁকে। ধমকের সুরে জিজ্ঞাসা করছে, ‘এখানে কী করেন? মহিলা মানুষ রাত ১২টায় এখানে কেন?’ বলতে বলতে মারার ভঙ্গি করলে পেছন থেকে আরেকজন বলে ওঠে, ‘ক্যালানি দিতে দিতে আসতেসি, বুঝতে পারসেন? ক্যালানি খাবেন? ছলে যান ছলে যান।’ আরেকজন বলে, ‘পুরা বিচের পরিবেশ এরা নষ্ট করে ফেলল।’ তারপর গালাগালি করছে এবং সেখান থেকে উঠে চলে যেতে একভাবে জোর গলায় নির্দেশ দিচ্ছে। ক্যামেরায় অনেক যুবককেই এ ঘটনায় যুক্ত থাকতে দেখা গেছে। আরও দেখা গেছে সেই লাঠিয়াল লোকটিকেও। তখনও তার হাতে লাঠি। মেয়েটিকে ভয় দেখানো হয় এবং সেখান থেকে উঠে যেতে বাধ্য করে সেই মব। সম্ভবত এ ভিডিও সেই মেয়েটিকে কান ধরে ওঠবস করানোর আগের ঘটনা কিংবা পৃথক ঘটনাও হতে পারে।
এর পরের ভিডিওটি সেই নারীর সবার সামনে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার। সেখানে ‘কড়াই’ রেস্টুরেন্টের সামনে একটি ঘরে কয়েকজন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। এক নারী এসে ভয়ার্তভাবে তাঁর মোবাইল ফোনটি ফেরত চাচ্ছেন। তিনি অনেক বেশি ভীত ছিলেন, কারণ তাঁকে মারধর করা সেই লাঠিয়াল তাঁর পাশেই ছিল। তিনি সেখানে উপস্থিত সবার কাছে মাফ চাচ্ছেন এবং আকুতি জানাচ্ছেন, তাঁর মোবাইল ফেরত দিলে তিনি টিকিট কেটে এলাকা ত্যাগ করবেন।
শুধু এগুলো করেই শেষ হয়নি সেই লাঠিয়ালের কর্মকাণ্ড, সে ফেসবুকেই সগর্বে পুলিশকে জানিয়েছে, সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ কাজ করেছে। কিন্তু প্রথম প্রশ্ন হলো, সেখানে পুলিশ ছিল না কেন?
ঘটনা জানার কতক্ষণ পরে পুলিশ সেখানে গিয়ে কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে?
জানা গেছে, উপদেষ্টাদের একজন ফেসবুক থেকে খবরটা জেনে সেই লাঠিয়ালকে গ্রেপ্তারে ভূমিকা রেখেছেন।
এর আগে ৭ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৬৫ বছর বয়সী এক নারী গণধর্ষণের শিকার হন। সেই নারীকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে শাহবাগ থানায় নিয়ে এসেছিলেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরে পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের সহায়তায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় এবং তিনি এখনও সেখানেই চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় শাহবাগ থানার এসআই জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে মামলা করেছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ও মূলধারার খুব বেশি গণমাধ্যম প্রকাশ করেনি।
৫ আগস্টের পর নারীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের সহিংসতার চিত্র আমরা দেখেছি। গত ২৯ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে ঢাকার শ্যামলীতে ভাসমান যৌনকর্মীদের লাঠি দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে এক যুবককে। সেই ঘটনা দেখে একজন যৌনকর্মীর সন্তান আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলে জানা গেছে। ফেসবুকে এটি ব্যাপক প্রচারের পরে একজন উপদেষ্টা সেই এলাকার থানাকে বিষয়টি দেখতে নির্দেশ দেন। তবে সেই যুবক গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা, তা জানা যায়নি।