গত ২৯ আগস্ট বহুল আলোচিত গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সই করার দুই সপ্তাহের মাথায় ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এই সনদে স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে ‘গুম সংস্কৃতি’র সমাপ্তি ঘটানোর জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। তিনি জানান, ফ্যাসিবাদী শাসনের ১৫ বছরে গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করার জন্য একটি কমিশন গঠন হয়েছে। ‘আয়নাঘরগুলো’ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি ভাষণে উল্লেখ করেন।
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সই করার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার তথা বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করল, সেটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু এরই মধ্যে কিছু দুঃখজনক ঘটনাও ঘটছে এবং বছরের পর বছর যেসব ঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা বিনষ্ট করেছে, সে ঘটনাগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না। যেমন যৌথ বাহিনীর চলমান অভিযানে আটকের পর গাইবান্ধায় দুজন এবং গোপালগঞ্জে একজন নিহতের অভিযোগ উঠেছে।
এর মধ্যে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলায় যৌথ বাহিনী আটক করার পর দুজনের মৃত্যুর প্রতিবাদে ১২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার মানববন্ধন করেছেন স্থানীয়রা। তাঁদের অভিযোগ, আটকের পরে রাতভর তাঁদের নির্যাতন করা হয়েছে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, ৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে যৌথ বাহিনী সাঘাটা উপজেলার ভরতখালী হাটে অভিযান চালায়। এ সময় ওই এলাকার গোবিন্দি ও বাঁশহাটি থেকে ইউপি চেয়ারম্যানসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়। পরদিন সোহরাব হোসেন আপেল (৩৫) ও শফিকুল ইসলাম (৪৫) নামে দুজনের মৃত্যু হয়।
পুলিশের দাবি, আটকের পর অসুস্থতাজনিত কারণে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। সোহরাব হোসেন সাঘাটা ইউপি চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন সুইটের ভাতিজা এবং শফিকুল ইসলাম চেয়ারম্যানের বাড়িতে কাজ করতেন বলে জানা গেছে।
এর দুই দিন আগে গোপালগঞ্জে এলাহী শিকদার (২০) নামে এক তরুণের মৃত্যু নিয়েও অভিযোগ ওঠে। ৮ সেপ্টেম্বর রাতে কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এর আগে ৩ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর একটি টিম এলাহীকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন তাঁকে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। মৃত্যুর পরে তাঁর কিছু ছবি দেখা গেছে, যেখানে তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মৃত এলাহী শিকদার কাশিয়ানী উপজেলার নিজামকান্দী ইউনিয়নের ফলসি বাজারে পুরি, শিঙাড়া বিক্রি করতেন।
রাষ্ট্রের যেকোনো বাহিনীর হাতে আটক বা গ্রেপ্তারে নির্যাতনে কারও মৃত্যু হলে বছরের পর বছর যে ধরনের বিবৃতি বা ব্যাখ্যা দেওয়া হতো—সেখানে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। প্রতিটি মৃত্যুকেই অসুস্থতাজনিত কিংবা ‘হার্ট অ্যাটাক’ বলে দাবি করা হয়। প্রশ্ন হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের ধরার পরে তাঁরা কেন অসুস্থ হয়ে পড়েন? গ্রেপ্তার বা আটকের পরে কী এমন ঘটনা ঘটে যে তাঁকে হাসপাতালে নিয়েও বাঁচানো যায় না? ধরা যাক, সম্প্রতি যাঁরা যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটকের পরে মারা গেছেন, তাঁরা অপরাধী। কিন্তু তারপরও কি তাঁদের বিনা বিচারে মেরে ফেলার অধিকার কোনো বাহিনীর আছে?
২০১৩ সালে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইন সংসদে পাস হয়। প্রশ্ন হলো, গত ১১ বছরে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু কি বন্ধ হয়েছে? যদি বন্ধ না হয়, তাহলে এই আইনে সংশ্লিষ্ট পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কয়টি মামলা হয়েছে? সেই মামলার পরিণতিই বা কী? এ রকম একটি কঠোর আইন থাকার পরেও কেন হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বন্ধ হচ্ছে না? রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সংস্থাগুলো কি এই আইন পাত্তা দিচ্ছে না, নাকি অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়া তথা সুরক্ষার নিশ্চয়তা রয়েছে বলে তারা আইনের তোয়াক্কা করছে না?
প্রসঙ্গত, মহানবী হজরত মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে কটূক্তি করায় ৪ সেপ্টেম্বর খুলনায় উৎসব মণ্ডল (১৮) নামে এক কলেজছাত্রকে ধরে এনে নগরীর সোনাডাঙ্গায় ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের (সাউথ) কার্যালয়ে নিয়ে যান কয়েকজন শিক্ষার্থী। কিন্তু এরপরে কয়েক শ লোক পুলিশের কার্যালয় ঘেরাও করে। এ সময় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরাও সেখানে গিয়ে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে রাত পৌনে ১২টার দিকে উত্তেজিত জনতা অফিসের তিনতলায় প্রবেশ করে উৎসব মণ্ডলকে গণপিটুনি দেয়। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রথমে তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হলে পরে তারা জানায় যে উৎসব মণ্ডল বেঁচে আছেন। এ বিষয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর থেকেও একটি বিবৃতি দেওয়া হয়।