ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে 'স্বৈরাচার' শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সুযোগ এসেছে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের। রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতর স্বৈরাচারী উপাদান যাতে কোনোভাবেই না থাকে, এ বিষয়ে এক হয়ে দাঁড়িয়েছে সবাই। দেশের এমন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স কেবল একমাস পেরোল। ইতোমধ্যে সংবিধানসহ আরও বেশকিছু বিষয় সংস্কারে কাজ শুরু করেছে তারা। দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় নিপীড়িত মানুষের প্রত্যাশা তাদের প্রতি অনেক।
এই গণঅভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম, সংবিধান কেন পুনর্লিখন প্রয়োজন, এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয়, গণমামলা-গণগ্রেপ্তারের সংস্কৃতি, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র অনাবাসিক ফেলো ও আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (এআইবিএস) প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রীয়াজ।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আলী রীয়াজ: এই আন্দোলনটি আসলে অকস্মাৎ হয়নি। ছাত্রদের আন্দোলনে জনমানুষের অংশগ্রহণ এবং এটিকে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরের পেছনে ইতিহাস আছে। গত ১৫ বছর ধরে স্বৈরশাসনের যে নিপীড়ন, বহু মানুষের প্রাণহানি, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা—এগুলো বড় ভূমিকা পালন করেছে। এসব ঘটনার সঙ্গে ৩৬ দিনের ছাত্র আন্দোলন বা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সংমিশ্রণই নির্ধারিত করেছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ভাগ্য।
কোটা সংস্কারে ছাত্রদের আন্দোলনে সাধারণ মানুষ প্রথমেই যুক্ত হননি। অবশ্যই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি জনমানুষের সমর্থন ছিল। সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ-নিপীড়নের বহিঃপ্রকাশ থেকে। ছাত্রদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। আবু সাঈদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আন্দোলন রূপান্তরিত হয়েছে, এতে জনমানুষের সংযুক্তি ঘটছে। আন্দোলনে যারা নিহত বা আহত হয়েছেন, তারা সবাই শিক্ষার্থী নন, তাদের মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিক আছে, সাধারণ মানুষ আছে, দিনমজুর আছে, দোকানের কর্মচারী আছে, মধ্যবিত্ত মানুষ আছে।
শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশে একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে তার ওপর নির্ভর করে দেশ পরিচালনা করছিল। তরুণ শিক্ষার্থীরা ভয় ভেঙে দিতে বিশাল ভূমিকা পালন করেছে। এই কাজ তারা ছাড়া আর কেউ করতে পারছিলেন না। ছাত্ররা যখন বলেছে সরকার স্বৈরাচার, হাসিনা স্বৈরাচারী, তখন মানুষ ভয়ের ওই আবহ থেকে বেরিয়ে এসেছে, লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে।
স্বৈরাচারের পতনকে কেউ বলছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা, কেউ বলছে গণঅভ্যুত্থান, কেউ বলছে বিপ্লব। আপনি কোনটা বলবেন?
আলী রীয়াজ: এটি গণঅভ্যুত্থান, গণমানুষের অভ্যুত্থান। গণঅভ্যুত্থান এই কারণে যে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে স্বৈরাচারকে হটানো হয়েছে। আর বিপ্লব বলব না এ কারণে যে বিপ্লবের পর নেতৃত্বদানকারীরা সরকার গঠন করে। এক্ষেত্রে তা হয়নি।
এটাকে আমি দ্বিতীয় স্বাধীনতাও বলব না। কারণ আমি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাখতে চাই। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পরও সেটিকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলা হয়েছিল। এবার বাংলাদেশের জনগণের অর্জন স্বৈরাচারী ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ। জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এটা অর্জন হয়েছে, ফলে আমি এটাকে গণঅভ্যুত্থান বলি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম এক মাসের কার্যক্রম নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আলী রীয়াজ: একটি বিশেষ পরিস্থিতির কারণে সাধারণ মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা রেখেছেন এবং দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। গত ১৫ বছর ধরে গোটা রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন যারা সরকারে আছেন, তাদের চ্যালেঞ্জ যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। সবকিছু তারা সঠিক করছেন এমন বলা যাবে না। কিছু সমালোচনাও আছে। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় বলব, বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা অগ্রসর হচ্ছেন। পিছিয়েও যাচ্ছেন না, থেমেও থাকছেন না। তবে, আরও গতিশীল হলে খুশি হতাম।
পুলিশ প্রশাসন ভেঙে পড়েছে, যেটিকে পুনর্গঠন করা এখনো সম্ভব হয়নি। দেখতে পাচ্ছি অস্থিতিশীলতা তৈরির জন্য এক বা একাধিক শক্তি কাজ করছে। শুধু যে দেশের মধ্য থেকে হচ্ছে তা না, দেশের বাইরে থেকে উসকানি আসছে, এক ধরনের চাপ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে।