৫ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর। অন্ধকার যুগ অবসানের এক মাস। একেবারেই ভিন্নরকম আবহ। সহস্রাধিক জীবনের বিনিময়ে অর্জিত নতুন স্বাধীনতার মাসপূর্তি। দুর্বিনীত নিষ্ঠুর শাসক শেখ হাসিনামুক্ত বাংলাদেশের প্রথম মাস। দীর্ঘ ষোলো বছরান্তে রাজনীতির বাইরের মানুষরা চালকের আসনে। প্রায় অচল রাষ্ট্রযানের স্টিয়ারিংয়ে হঠাৎ করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের। তবু থেমে থাকার সুযোগ নেই। এগোতেই হচ্ছে। ধ্বংসস্তূপের ছাই থেকে সোনা ফলানোর দায় পড়েছে। বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ এরই মধ্যে চোখ রাঙালেও ভড়কে যাননি গণমানুষের আস্থাভাজন মানুষগুলো। বরং দৃঢ়-দৃপ্ত পদক্ষেপে এগোচ্ছেন অদম্য তারুণ্য শক্তির সাহসে ভর করে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অকুণ্ঠ সমর্থন তাদের বাড়তি পাওয়া।
গেল মাসের প্রতিটি দিনই ছিল আশা-নিরাশা আর উৎসাহ-উৎকণ্ঠার দোলাচলে মিশ্র। একদিকে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে মুক্তির প্রহর গুনতে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীর বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার সময়। মন খুলে কথা বলা, স্বাধীন চিন্তা ও নির্ভয়ে পথচলার নতুন দিন। অন্যদিকে অভাবনীয় জনবিস্ফোরণের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের জন্য অকল্পনীয় দুঃস্বপ্ন ও অমানিশার সূচনাকাল। নেতাকর্মীদের অকূল দরিয়ার মাঝে রেখে প্রাণভয়ে পালিয়েছেন ক্ষমতাদর্পী কথিত লৌহমানবী। সঙ্গী করেছেন কেবল নিজের সহোদরাকে। কাউকে কিছু বলে যাননি, কয়ে যাননি। মহাবিপর্যয়ের আকস্মিকতায় হতবিহবল সবাই। দলটির প্রথম সারির সব নেতা ডিপ আন্ডারগ্রাউন্ডে। মাঠকর্মীরা আতঙ্কে দিশেহারা।
ছাত্র-জনতার গণবিপ্লব-উত্তর নতুন বাংলাদেশের পালে এখন নতুন হাওয়া। যদিও হিমালয়সম চ্যালেঞ্জ আছে বিশ্বনন্দিত নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে। পরাজিত শক্তি নানা রূপে, হরেকরকম বাহানায় হুমকি ও প্রচণ্ড চাপে ফেলতে চাইছে তাদের। গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে কেবলই যাত্রা শুরু করেছেন। মধুচন্দ্রিমাকাল বলা যায়। এরই মধ্যে দাবির বিশাল বহর নিয়ে হাজির নানা গোষ্ঠী, সঙ্গে আক্রমণাত্মক ও যুদ্ধংদেহী ভাব। পতিতদের নকশায় প্রতিবিপ্লবের অপচেষ্টাও হয়েছে বারকয়েক।
এদিকে আকস্মিক শৃঙ্খলমুক্ত রাজনীতিতেও চোখে পড়ছে নতুন সব উপসর্গ। সহযাত্রী রাজনীতিকরা পা বাড়াচ্ছেন শত্রুতার কণ্টকাকীর্ণ পথে। বিজয় উদযাপনের উপাদানে সংযমের সংকট দিচ্ছে নতুন বার্তা। পার্শ্বক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে অভ্যুত্থানে সহায়ক শক্তি হিসাবে ভূমিকা রাখা দলগুলোকে। মাঠ সামলাতে হিমশিমে শীর্ষ নেতৃত্ব। বহুমাত্রিক চাপে সতর্কবার্তা দিয়ে বলতে হচ্ছে-‘এখনই আত্মতুষ্টি নয়, বিজয় কিন্তু এখনো অনেকদূর।’ আরেক দলে ভাব ফুরফুরা। নেতাকর্মীরা ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে বেসামাল। ক্ষমতার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার আভাস দিচ্ছেন তারা।
হাসিনামুক্ত বাংলাদেশে নতুন সরকার কাজ করছে দিন পঁচিশেক ধরে। এরই মধ্যে লুটেরা ও গণহত্যায় জড়িতদের পাকড়াও করা হয়েছে। দানবিক রাষ্ট্র তৈরির অনেক কারিগর খাঁচাবন্দি হয়েছেন। এখনো চলছে। দুর্নীতির বরপুত্র রাঘববোয়ালরা আটকা পড়তে শুরু করেছে দুদকের জালে। কুখ্যাত আয়নাঘরের অনেক বন্দি নতুন জীবনে ফিরেছেন। কারামুক্ত হয়েছেন আওয়ামী শাসনের রাজবন্দিরা। নিপীড়নমূলক অনেক মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। বিপর্যস্ত বিচারব্যবস্থা পুনর্গঠন হচ্ছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বৈরতন্ত্রের লাঠিয়ালমুক্ত হয়েছে।
ভঙ্গুর অর্থনীতিতে গতি ফিরতে শুরু করেছে। দলবাজিতে নাজুক প্রশাসনযন্ত্র মেরামত হচ্ছে। বাজারে খানিকটা হলেও স্বস্তি মিলছে। জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছে। পরিবহণ ও বাজারঘাটে চাঁদাবাজি সাময়িকভাবে হলেও বন্ধ হয়েছে। ফ্যাসিবাদের খুঁটিগুলো উপড়ে গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথনকশা তৈরির কাজ চলছে। রাষ্ট্র সংস্কারের ফর্মুলা আসছে নানা মহল থেকে।
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভারতের পানি আগ্রাসনে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকার-জনগণ একাট্টা হয়ে নয়া দৃষ্টান্ত রেখেছে। কূটনীতিতে সুবাতাস বইছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সম্মানে আরব আমিরাত মুক্ত করে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সমর্থনকারী ৫৭ জেলবন্দি বাংলাদেশিকে। বলা যায়, সবকিছু মোটামুটি ইতিবাচক ধারায় এগোচ্ছে। যদিও আগামী দিনের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে সংশয় ও শঙ্কা দানা বাঁধছে।