বাঙালির জীবনাচরণে নানান উপযোগের কথা বলতে গেলে একটা বিষয় না বললে খুব ফাঁক থেকে যাবে, সেটা হচ্ছে ‘প্রবচন’, যা বাংলার এক অমূল্য রত্নভান্ডার। এখানে ধর্ম নেই, বৈষম্য নেই, ঝগড়া নেই, রাজনীতি নেই। যা আছে তা যেন শুধু সবার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার, মিশে থাকার চেষ্টা।
সেই যে ছেলেবেলায় শোনা, ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’ বাক্যটি—এই লাজহীনতার কথা বলা বাক্যটির মাঝে যে সাম্যের কথা, তা যুগে যুগে মনে-মগজে নিয়েই বাঙালি পথ চলে। তবু হুজুগে বাঙালিকে অবধারিতভাবে বলা যায়, ‘একে তো নাচুনি বুড়ি, তার ওপরে ঢোলের বাড়ি!’ ঢোল কে বাজাল তা না জেনে চিরকাল ‘চিলে কাক নিয়েছে’ শোনা রোমান্টিক বাঙালি অদৃশ্য চিলের খোঁজ করে গেছে, যাবে।
আর বাস্তব জগতে আখের গোছাতে ব্যস্ত হতে হতে বলেছে, ‘তেলা মাথায় ঢালো তেল, রুক্ষ মাথায় ভাঙো বেল।’ কেন এই কথা? ‘বেলতলায়’ যাওয়া যে বাঙালির অমোঘ নিয়তি! এই বাঙালিই আবার একসময় জোর গলায় ঠিক বলে বসে, ‘ছায়া ভালো ছাতার তল, বল ভালো নিজের বল।’ কেন? আরে ভাই, যতই রাগ-হিংসা আর ক্ষোভ থাকুক না কেন, বাঙালি যে ভীষণ বন্ধুবৎসলও। তাই তো বন্ধুর জন্য সে ঠিকই বলে উঠবে, ‘যদি থাকে বন্ধুতে মন, গাঙ সাঁতরাইতে কতক্ষণ?’
হাজার বছর আগে এক অতি বিদুষী নারী এমন অনেক অনেক প্রবচনে বাঙালির জীবনচিত্র এঁকে গেছেন। বলে গেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, এমনকি দৈনন্দিন জীবনাচরণের সরল কথাগুলো। তাঁর নাম খনা। জীবনাচরণের কোন বিষয়টা বাদ গিয়েছিল তাঁর সুতীক্ষ্ণ ধীশক্তি থেকে—যদি ভাবতে যাই ঠিক ঠিক ফেল মারতে হবে! বাংলার ঋতুবৈচিত্র্যের সঙ্গে পারিপার্শ্বিকের সম্পর্ক নিয়ে তিনি বলেছিলেন অসংখ্য প্রবচন, যা আজও বিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে।
‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পুণ্যি দেশ’ বা ‘যদি হয় চৈতে বৃষ্টি, তবে হবে ধানের সৃষ্টি’, আবার ‘চৈত্রে দিয়া মাটি, বৈশাখে কর পরিপাটি’...আরও আছে—‘ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন শীঘ্র হবে বর্ষা জানো’, ‘আউশ ধানের চাষ লাগে তিন মাস’, ‘খনায় বলে শোনো ভাই, তুলায় তুলা অধিক পাই’। খনা আরও বলেছিলেন, ‘জ্যৈষ্ঠে খরা, আষাঢ়ে ভরা, শস্যের ভার সহে ধরা’, ‘আষাঢ়ে পনের শ্রাবণে পুরো, ধান লাগাও যত পারো’, ‘তিন শাওনে পান, এক আশবিনে ধান’।
প্রখর তাপদাহে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রাচীন লোকটি যখন বলে, ‘গাছে গাছে আগুন জ্বলে, বৃষ্টি হবে খনায় বলে’, চোখে ভাসে এক সাহসী-সত্য-একাকী নারীর কথা! জীবনের সার সত্য অকাতরে বলে দেওয়ার জন্য প্রিয় আপনজন যাঁর জিভ কেটে দিয়েছিল! তবু তিনি থামেননি। বলে গেছেন তাঁর কথা, যা আজও আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিকে আলো করে রেখেছে। এ যেন বাঙালির এক যাদুবাস্তবতা!
বাস্তুশাস্ত্রের নিয়মনীতির কথাও সেই হাজার বছর আগে বলে গেছিলেন তিনি। তাই তো বর্তে থাকা বাঙালির কানে আজও সেই বাক্য বাজে, ‘উত্তর দুয়ারি ঘরের রাজা/দক্ষিণ দুয়ারি তাহার প্রজা/পূর্ব দুয়ারির খাজনা নাই/পশ্চিম দুয়ারির মুখে ছাই!’ কী অনন্য! পৃথিবীর বড় বড় স্থাপত্যবিদও স্বীকার করতে বাধ্য হবেন এমন কঠিন সত্যকে। এই খনাই বলে গেছেন, ‘মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা, যেথা ইচ্ছা সেথা যা।’ আলো-বাতাসহীন অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ থেকে আলোর দিকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন, ‘আলো হাওয়া বেঁধো না, রোগ ভোগে মোরো না।’ আবার এমন কিছু চিরকালীন কথা বলেছেন যাতে বাঙালির কিছু সনাতন চরিত্র ফুটে ওঠে—‘পরের বাড়ির পিঠা খাইতে বড়ই মিঠা’, ‘মেয়ে নষ্ট ঘাটে, ছেলে নষ্ট হাটে’, ‘ভাত দেওয়ার মুরোদ নাই, কিল দেবার গোঁসাই’, ‘নদীর জল ঘোলাও ভালো, জাতের মেয়ে কালোও ভালো’, ‘নিজের বেলায় আটিগাটি, পরের বেলায় চিমটি কাটি’। প্রতিটা বাক্যেই যেন আবহমান বাঙালির এক চেনা চেহারা দেখা যায়।