দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক মাস পূর্ণ হতে বেশি বাকি নেই। সরকারটি কতদিনের জন্য এসেছে, তা অবশ্য সুনির্দিষ্ট নয়। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে বলেছেন, দায়িত্ব পালন শেষে তারা কবে যাবেন, সে সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আসবে। তাদের ‘প্রাথমিক নিয়োগকর্তা’ ছাত্রনেতারাও বলবেন। একটা সময় পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনকালে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিত। সে বিধান এখন নেই। এ জায়গাটা থেকে নির্বাচন ঘিরে সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। সঙ্গে অপশাসন গ্রাস করেছে দেশকে। এ প্রেক্ষাপটেই কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন একপর্যায়ে সরকারেরই পতন ঘটিয়ে দিয়েছে। আর এ পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাদের সামনে কেবল নির্বাচন নয়; সংস্কারের প্রশ্নও রয়েছে। সে কারণেই সরকারটির মেয়াদ একটু দীর্ঘ হবে বলে মনে হচ্ছে। মানুষ এ আলোচনাও বেশি বেশি করছে যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনতে কতদিন লাগবে তার।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেও কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনতে বেগ পেতে দেখা যেত। এ লক্ষ্য অর্জনে বিশেষ করে আগের সরকারের ‘সাজিয়ে যাওয়া প্রশাসন’ বদলাতে হতো তাদের। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মুহূর্তেই বিপুলসংখ্যক সচিবকে একযোগে বদলি করে। পরে রাজনৈতিক গডফাদারদের বিরুদ্ধেও নেয় কঠোর ব্যবস্থা। তাতে আবার ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বিনষ্ট হওয়ার। এটা স্মরণ করা হলো বলতে যে, সব পক্ষের পছন্দমতো কাজ করা কঠিন। কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারও তাই বিতর্কমুক্ত অবস্থায় বিদায় নিতে পারেনি। নির্বাচনে পরাজিতরা বরাবরই ওই সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে তুলেছে প্রশ্ন। তারপরও সত্য যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর সময় সিংহভাগ মানুষ স্বস্তিবোধ করেছে। পেয়েছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনও। তবে সমস্যা বেড়ে উঠেছে অন্য দিক দিয়ে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারা গণতন্ত্র ও সুশাসন জোরদারের বিপরীত কাজই করেছে কম-বেশি। এক্ষেত্রে ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে ‘মন্দের প্রতিযোগিতা’ই বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। সেটা ছিল নব্বই-পরবর্তী সময়ের দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা।
এ অবস্থাতেই এসেছিল ‘ওয়ান-ইলেভেন’। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বিধানকেও অপব্যবহারের চেষ্টা হয়। যা হোক, ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রায় দু’বছর দেশ চালিয়ে বিদায় নেয় নির্বাচন দিয়ে। তারা এতটা দীর্ঘ সময় নেওয়ার কারণ-ওই সরকারের সামনেও ছিল সংস্কারের প্রশ্ন। তবে নানা কারণে শেষতক কোনো সংস্কারই তারা করে উঠতে পারেননি। বহুল আলোচিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানও হয়নি সফল। এতে অর্থনীতিতে বরং বিপরীত প্রভাব পড়ে। মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ওঠে। এ অবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত পরিস্থিতিকে করে তোলে সুকঠিন। অবশেষে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে তারা বিদায় নেন। সেটি নিয়েও ওঠে কিছু প্রশ্ন। তার চেয়ে বড় কথা, এর ভেতর দিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ চালাতে থাকে আপন খেয়ালে। তারা সংস্কারের চাহিদাকে শুধু অগ্রাহ্য করেনি; এর বিপরীত ধারায় চলতেই হয়ে পড়ে অভ্যস্ত। সেটা না ঘটলে দেশে আজ যে নজিরবিহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা অন্তত হতো না। প্রথমবারের মতো একটি সরকারকে পালাতে হয়েছে দেশ থেকে। সঙ্গে পুলিশকে। তাদের দায়িত্বে ফিরিয়ে আনতে এখনো বেগ পেতে হচ্ছে সরকারকে। নজিরবিহীন দলীয়করণের শিকার জনপ্রশাসনেও নেই গতি। সেনাবাহিনীতেও সংস্কারের একটা প্রক্রিয়া চলছে। হাসিনা সরকার টানা ১৫ বছর দেশ চালাতে গিয়ে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যার দলীয়করণ করেনি। তবে এটা সবচেয়ে বেশি হয় পুলিশে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শুরুতেই তাই পুলিশ নিয়ে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশকে কাজে ফেরাতেও লেগে গেল অনেকদিন!
সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো জরুরি পরিবর্তন এনে পুলিশকে সক্রিয় করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া। তবে সে কাজে স্বভাবতই দেরি হচ্ছে। জায়গায় জায়গায় পুলিশের কাজে যেতে হচ্ছে সেনাবাহিনীকে। ধামরাইয়ে কোনো এক পোশাক কারখানার অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে সংঘর্ষ ও মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটলে সেখানেও যেতে হয় সেনাসদস্যদের। ওখানে পুলিশ গেলেও তারা হয়তো যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়নি। এরই মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একাধিক অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর চিকিৎসকরা কর্মবিরতিতে গেলে তাদের দাবির মুখে ওখানে মোতায়েন করতে হয়েছে সেনা ও বিজিবি সদস্যদের। চিকিৎসক ধর্মঘট সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার মতো একটা পরিস্থিতিও দেখা দিয়েছিল। এসব ঘটনায় অনেকেই নতুন সরকারকে সংকটে ফেলার ‘চক্রান্ত’ দেখতে পান। তবে সবকিছুতেই চক্রান্ত আছে বলে ধরে নেওয়ার অবকাশ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, একটি সরকারকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয় অভিযোগ না করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যে সবকিছুতে ‘চক্রান্ত’ খুঁজতে দেখা যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। ধীরেসুস্থে পরিস্থিতি সামলে এগোনোর চেষ্টাই তার মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত। তবে প্রশাসনিক রদবদলসহ কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া না হলে জনমনে আস্থা জাগানো কঠিন বলেই অনেকের ধারণা। যে পরিস্থিতিতে তাদের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল, সেটা বিপর্যয়কর সন্দেহ নেই। একটা চরম কর্তৃত্ববাদী সরকার ছিল ক্ষমতায় এবং তারা বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় সবকিছু দলীয় বৃত্তে নিয়ে এসেছিল। একের পর এক যেনতেন নির্বাচন করে ফ্যাসিবাদ কায়েমই ছিল তার লক্ষ্য। এ অবস্থায় তাদের উৎখাতে একটা নজিরবিহীন রক্তক্ষয়ী আন্দোলনও হয়ে গেছে দেশে। অতঃপর ক্ষমতাচ্যুতদের ওপর পালটা যে আঘাত শুরু হয়েছে, সেটা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ। ক্ষমতার পরিবর্তনে অতিউৎসাহী হয়ে উঠতে দেখা গেছে একাধিক পক্ষকে। এর মধ্যে একটি বড় রাজনৈতিক দলকে নিজেদের বেপরোয়া কর্মী সামলাতে কিছু পদক্ষেপ নিতেও দেখা যাচ্ছে। সরকারের জন্য সেটি কিছুটা সহায়ক হবে বৈকি।