মৌতলার মমিন মহাজনের মেয়ে মরিয়ম ২০০৯-এর মার্চে যেদিন কালিগঞ্জ কলেজে আইএতে ভর্তি হতে আসে সেদিন দেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৫৮ লাখ, জিডিপি ৭ লাখ ৫ হাজার ৭২ কোটি টাকা, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৭ হাজার ৪৭১ মিলিয়ন ডলার, বৈদেশিক দায়ের স্থিতি ২০ হাজার ৮৫৮ মিলিয়ন ডলার, আমদানি ব্যয় ২০ হাজার ২৯১ মিলিয়ন ডলার, রফতানি আয় ১৫ হাজার ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার, ডলারপ্রতি টাকার বিনিময় হার ৬৮ দশমিক ৮০ টাকা, মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। ভর্তি পরীক্ষায় গোঁফওয়ালা যে স্যার আমদানি ও রফতানি ফিগার জানতে চেয়েছিলেন তিনি নিজেই তা সঠিকভাবে জানতেন কিনা মরিয়ম বুঝতে পারেনি। মরিয়ম এসব জানত না বুঝত না। সে শুধু জানত তার নানা ভ্রুলিয়ার বাচা সরদারের মাছের ঘের আছে। সেখানকার চিংড়ি বিদেশে রফতানি হয়। আর আমদানির বানানে হ্রস ই কার না দীর্ঘ ঈ কার হবে তার ব্যাকরণ শিক্ষক মাহমুদপুরের শওকত মল্লিক নিজেও মনে হয় ভালো করে জানত না। তাই তার এটিও শেখা হয়নি।
মমিন মহাজনের মেয়ে মরিয়ম কলেজে পড়ে—এটাতেই সন্তুষ্ট গ্রামের সবাই। এ বয়সে মরিয়মের শ্বশুর বাড়িতে থাকার কথা। কিন্তু কেন জানি তার মা মতিজান গ্রামীণ ব্যাংকের লোন নিয়ে হাঁস-মুরগি লালন-পালনের কাজে কিছু একটা করতে পারছে। তার শখ ও পণ মেয়ে মরিয়মকে সে পড়াবেই। মতিজান বোঝে যত শিক্ষিত হবে মেয়ে, তত তার মানসম্মান বাড়বে। স্বামীর ঘরে হাত-পা বেঁধে বসে থাকতে হবে না।
শীতলপুরের ওপর দিয়ে যে রাস্তাটা বসন্তপুর কালিন্দি ঘাট অবধি গিয়েছে সেই রাস্তার মাঝামাঝি জায়গায় ডা. মুজিব আর তার স্ত্রী ডা. রুবি একটা নতুন উচ্চ বিদ্যালয় খুলেছে; আবাসিক ছায়াঘেরা স্কুলটি বেশ পরিপাটি। ঢাকা থেকে হেডমাস্টার শফিক এসেছেন। প্রচণ্ড কর্ম উদ্যোগী নবীন অথচ অভিজ্ঞ শিক্ষক। আশেপাশের তো দূরের কথা সেই সুদূর কইখালী ভেটখালী থেকেও ছেলেরা পড়তে এসেছে এখানে। নলতা স্কুলের ছাত্র ডা. মুজিব ঢাকায় নামকরা হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন। করোনার সময় তিনি মারা যান। তার ইচ্ছা ছিল স্কুলে তার হেডমাস্টার সাহেবের মতো নিবেদিতপ্রাণ প্রধান শিক্ষক তার স্কুলটিকে যেন গড়ে তোলেন। এ অজপাড়াগাঁয়ে শিক্ষার্থীরা শুধু রচনা মুখস্থ করে, পাটিগণিতের অংক মিলিয়ে, ইতিহাস ভূগোলের পাতায় চোখ বুলিয়ে বৈতরণি পার হবে কেন। পরীক্ষায় তাদের সাধারণ জ্ঞান, দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং অর্থনীতি নিয়ে জ্ঞান বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রের পদস্থ এক কর্মকর্তা স্কুলের ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে এসে বললেন, ‘আমি অংকে অতিশয় কাঁচা ছিলাম। এক পরীক্ষায় শূন্যও পেয়েছিলাম। এখন দেশের আয়-ব্যয়ের হিসাবনিকাশ আমাকে মাথায় রাখতে হচ্ছে।’ তিনি নিজে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, চাকরি পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক, পরে নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগে। কেমন কিম্ভুতকিমাকার বেমানান পরিস্থিতি!
দেশে হিসাব মোটাতাজাকরণের চল তখনো চালু হয়নি। আশির দশকে তার হিসাব বিভাগে কাজ করার সময় ট্রেনিং একাডেমিতে পাটোয়ারী সাহেব নামে একজন তাদের উপযোজন হিসাব পড়াতেন। আর মকবুল সাহেব নামে একজন অতিরিক্ত পান খাওয়া হিসাব অফিসার এজি অফিসে উপযোজন হিসাব মেলাতেন বিকালে বসে বসে। এক খাতের টাকা আরেক খাতে দেখিয়ে বা বসিয়ে হিসাব মেলানোয় তার পারদর্শিতা তো ছিলই, রসিক মানুষটি পাবলিক অ্যাকাউন্টস মেলানোটা শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার মিলনের মতো রোমাঞ্চকর করে তুলতেন। না তখনো দেশে হিসাব মোটাতাজাকরণের কোনো খেয়াল (সুরকার আজাদ রহমানের সাধা সুরের খেয়াল নয়) জাগেনি, ওপর থেকে এ ধরনের কোনো চাপ চাপ আসেনি। এ রকম অবস্থা তখনো তৈরি হয়নি—যেমন ঘটেছিল তিন বিশেষজ্ঞ পরীক্ষার্থীর একই প্রশ্নের জবাব দিতে বলার বেলায়। রসায়ন, পদার্থবিদ্যা এবং ওকালতি পেশার তিন ব্যক্তিকে এক কোম্পানির নির্বাহী পদে নিয়োগ পরীক্ষায় ডাকা হয়েছিল। এক এবং অভিন্ন প্রশ্ন প্রত্যেকের কাছে— ২+১ সমান কত হয়? রসায়নের পরীক্ষার্থী মাথা চুলকিয়ে হাইড্রোজেন কার্বন মিশিয়ে অনেক হিসাব কষে বললেন, তিন, তিনই তো হয়। পদার্থের প্রার্থী নিউটন আইনস্টাইন সবার দুয়ারে ঘা দিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে সংশয়বাদীদের মতো (যদিও তা শুনলে বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন বোস স্বর্গ থেকেই ধমকাবেন) বললেন, মনে হয় ৩। উকিল সাহেব এসে প্রশ্ন শুনে ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে দিতে বললেন। তারপর তিনি নিজেই জানতে চাইলেন, ‘আসলে আপনারা ২ আর ১ একত্রে কত চান? কত হলে আপনাদের চলবে। আমি সেটাই করে দিতে পারব’। চাকরিটা সেই চালাক উকিলেরই হয়েছিল।
২০০৯-এর মার্চে মরিয়ম কালিগঞ্জ কলেজে ভর্তি হওয়ার দিন দেশের জিডিপি, ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ, ডলার—টাকার বিনিময় হার, জিডিপি যা ছিল তার আইএ পরীক্ষায় পাসের দিন সেসব মোটামুটি কিছুটা কমবেশি হচ্ছিল। তবু তা ছিল নিয়ম মেনে রসায়ন ও পদার্থবিদের হিসাব-কিতাবের মতো। কিন্তু ওকালতি মনোভাবসম্পন্ন আত্মীয় অধ্যাপক তখন সিলেকশন গ্রেড সিনিয়র সচিব হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। তিনি ও তার বস বুঝলেন তাদের নিয়োগ কিংবা নির্বাচনকারী কর্তাব্যক্তিরা কী চান? তারা চান দেশের উন্নয়ন, সামষ্টিক অর্থনীতির পরিচয় পরিস্থিতিকে, রিজার্ভ ও জিডিপি, রফতানি বাড়িয়ে দেখাতে যাতে দেশ শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির দিকে ধাবমান শুধু নয়, বরং দৌড়াচ্ছে; রোল মডেলের মেডেল পাওয়ার জন্য অদূর সামনে হাতছানি দিয়ে ডাকছে দেশকে নয় ক্ষমতালোভী সরকারকে। তারা হিসাব মোটাতাজাকরণের পাঁচ প্রকল্প: ১. ডাটা কনভার্সন, মেটা ডাটা প্রিপারেশন অ্যান্ড টাইম সিরিজ ডাটা কম্পাইলেশন ২. সার্ভেইস অ্যান্ড স্টাডিস রিলেটিং টু জিডিপি রিবেসিং ২০১৫-১৬ ৩. ইমপ্রুভিং অব জিডিপি কম্পাইলেশন অ্যান্ড রিবেসিং অব ইনডিসেস প্রজেক্ট ৪. ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অব স্ট্যাটিস্টিকস ইমপ্লিমেন্টেশন সাপোর্ট (এনএসডিএস) ৫. মডার্নাইজেশন অব ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস স্ট্যাটিস্টিকস প্রজেক্ট নিলেন যাতে জিডিপির বপু বাড়বে; বাড়বে অনেকগুলো পরিসংখ্যানের পরিসর আর ডলারের দাম ধমক দিয়ে এক জায়গায় ঠায় দাঁড় করিয়ে রিজার্ভের স্বাস্থ্য বাড়ানোর ‘গ্রিন’ কর্মসূচি নেয়া হলো হাতে। গ্রিন সাহেবরা তখন মহা ব্যস্ত। তার চামচা ডেপুটি যখন সন্ধ্যায় এক নৈশভোজে বললেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যে রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন থেকে ২২ বিলিয়নে নিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ’।
৭ মার্চেও ভাষণে ইনশাল্লাহ বলার মধ্যে যে আন্তরিকতা ও ঈমানদারি ছিল এই ডেপুটির মুখে ‘ইনশাল্লাহ’ই তো আসার কথা নয়, তথাপি তার পাতানো দাদাবাবু ওপারে বড় জায়গায় আছেন—এ খুঁটির জোরে হয়তো বা বিভিন্ন পদ ও পদবিতে এই ডেপুটির দাপট তখন ঠেকায় কে? পুরো ব্যাংক খাতের বারোটা বাজিয়ে তিনি এখন শোভন নিষ্কৃতি পাওয়ার অপেক্ষায়। রিজার্ভ ৪৮-৫০ বিলিয়ন অবধি উঠল। মন্ত্রণালয়প্রধানের মাথায় ১ বিলিয়ন ডলার হ্যাকিং হয়ে চুরি তেমন কিছু মনে হলো না। যারা ব্যক্তিগতভাবে ‘তিলে তিলে ডলার জমিয়ে রিজার্ভ এ পর্যায়ে নিয়ে যান, তারা কেন সাইবার অ্যাটাকে বিচলিত হবেন? এসব দায়িত্বপূর্ণ কাজ বশংবদদের হাওলায় দিয়ে বিদেশের বাহবা বা পদক কিংবা পুরস্কার কুড়োনোয় ব্যস্ত ছিলেন। রিজার্ভ বাড়ায় বিদেশীরা অকাতরে ধার দিতে এগিয়ে এল, সভেরেন গ্যারান্টি দেয়া হলো, সেই ধারের টাকা নিয়ে সবাই লুটপাটের মচ্ছবে নামলেন। আর অন্যসব হিসাব ও পরিসংখ্যানের স্ফীতির মেদ পুরো অর্থনীতিকে ডায়াবেটিস ধরিয়ে দিয়ে হাইপো হয়ে এখন হাসপাতালে আইসিইউতে কাতরাচ্ছে। ২০২৪-১৫ থেকে জিডিপি, রিজার্ভ ও আয়-ব্যয় বাজেটের সামঞ্জস্যহীনতায় দেদার বাড়তে থাকে দেশী-বিদেশী ঋণের বহর।