ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে পরিণত হলো এবং শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতন হলো। এই আন্দোলনের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল হাসিনা সরকারের পতন। কিন্তু আরও অনেক জনআকাঙ্ক্ষাও তৈরি হয়েছে। আপনার বিবেচনায় সে আকাঙ্ক্ষাগুলো কী?
সলিমুল্লাহ খান: হাসিনা সরকারের পতনের কারণটা যদি আমরা অনুসন্ধান করি তাহলে জনআকাঙ্ক্ষার একটা চেহারা ভেসে উঠবে। হাসিনা সরকারের প্রথম দোষ হলো ২০০৯ থেকে শুরু করে ২০২৪-এর ৫ আগস্ট পর্যন্ত তাঁর যে শাসনকাল, তাতে বড়জোর বলা যায় প্রথমটাতে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরের তিন মেয়াদের তিনটি নির্বাচনই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এ কারণে মানুষ জানে যে তাঁর সরকার অনির্বাচিত সরকার। আমাদের মতো প্রজাতন্ত্রে মানুষ রাষ্ট্রের উপর নিজের মালিকানা দাবি করতে পারে কেবলমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে। সেটাও যদি কেউ কেড়ে নেয়, তাহলে সেই জবরদখলকারী সরকারকে উৎখাত করা ছাড়া মানুষের আর কী উপায় থাকে!
জবরদখলকারী হাসিনা সরকার তাদের বৈধতার জন্য মুখে দুটি বয়ান দিয়ে আসছিল। তারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে একদলীয় ব্যাখ্যা দিয়েছিল। আমি বলব এই ব্যাখ্যাটা অর্ধসত্য, যেটা অসত্যের চেয়ে মারাত্মক। দ্বিতীয়টা উন্নয়নের বয়ান। সেই উন্নয়নে জনগণের কী লাভ হয়েছে সেটা বিচার করলে দেখা যায় জনগণের বিশেষ কিছু লাভ হয়নি। আয় বণ্টনের যে বৈষম্য সেটা কমেনি, বরং বেড়েছে।
এটা ঠিক যে দেশে কতগুলো চোখে পড়ার মতো উন্নয়নকর্ম হয়েছে। কিন্তু হাসিনার উন্নয়নের বয়ান মানুষ গ্রহণ করেনি। আমি এখানে অর্থনীতিবিদদের একটু সমালোচনা করতে চাই। উন্নয়ন নিয়ে তাদের যে মাপকাঠি সেটাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দেশের জনগণের মধ্যে হতাশা বেড়েছে, আফসোস বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, বঞ্চনাটা বেড়েছে। বেকারত্বের দিকে তাকালে সেটা দেখা যায়। বেকারত্বের জায়গা থেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত বলা যায়।
জনআকাঙ্ক্ষার প্রশ্নে যদি আসি, তাহলে প্রথমেই বলব, প্রত্যেক মানুষই চায় নিজের মর্যাদা। হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় খারাপ কাজ ছিল সাধারণ মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করা। কথায় কথায় মানুষকে অপমান করেছে তারা। দ্বিতীয় খারাপ কাজ হলো সাধারণ মানুষের বৈষয়িক স্বার্থকে একেবারে লঙ্ঘন করা। সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ সর্বশেষ তারা যে আইন করেছিল তার মাধ্যমে সরকারকে যেকোনো ধরনের সমালোচনা অথবা পরিহাস করার ক্ষমতা পর্যন্ত কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এতে বোঝা যায় হাসিনা সরকার প্রকৃত অর্থেই প্রতিনিধিত্বশীল ছিল না।
একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এই সরকারের আশু কর্তব্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্তব্য কী বলে মনে করেন?
সলিমুল্লাহ খান: হাসিনা টিকে ছিলেন তাঁর আগের আমলের অত্যাচার, অবিচার, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের যে ঐক্যের কারণে জনগণের মধ্যে যে ভয় ছিল তার সূত্রে। সেই ভয়কে মূলধন করেই হাসিনা টিকে ছিলেন। লোকে বলত, হাসিনা চলে গেলে যদি বিএনপি আসে! এটাকে বলা যায় ভারসাম্যজনিত শূন্যতা। পৃথিবী ও চাঁদের মাঝামাঝি মহাকাশে একটা জায়গা আছে, যেখানে নভোচারীর ওজন শূন্য হয়ে পড়ে। এ রকম একটা অচলাবস্থার মধ্যেই বিগত সরকার টিকে ছিল। বিএনপিই ছিল হাসিনার মূলধন।
গত ১৫ বছরে বিএনপি বহু আন্দোলন করেও সফল হতে পারেনি। এর কারণ বিএনপির ভেতরেও অজস্র টানাপোড়েন। বিএনপি একটা একক রাজনৈতিক দল নয়, অনেক দলের সমষ্টি। আওয়ামী লীগ খানিকটা দল হলেও সেটা এক পরিবার ও একব্যক্তিকেন্দ্রিক। ছাত্ররা সফল হয়েছেন এ কারণে যে, তাঁরা জনতাকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। এই জনতাকে বিএনপি আকৃষ্ট করতে পারেনি। ছাত্ররা পেরেছেন তাঁদের কোনো অলৌকিক গুণ আছে বলে নয়, তাঁদের সাহস ও দূরদৃষ্টির কারণে। হাসিনা সরকারও বুঝতে পেরেছিল ছাত্রদের শক্তি। তাই ছাত্রদের বুকে গুলি করতে তারা পিছপা হয়নি। এ ধরনের গুলিবর্ষণ পৃথিবীর সব দেশেই জনতাকে আন্দোলনে টেনে নিয়ে আসে।
এ ছাড়া আমাদের এখানে প্রচণ্ড বেকারত্ব সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় আর্থিক দুর্নীতির যে বিপুল চিত্র প্রকাশিত হলো সেটাও হাসিনা সরকারকে জনগণের সামনে সম্পূর্ণ উদোম করে দেয়। এই অবস্থায় একটা ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গও দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট মাসে সেটাই ঘটেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে ছাত্রদের আন্দোলনকে মূলধন করে। ছাত্ররা নিরপেক্ষ লোক হিসেবে বিশ্ববরেণ্য মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে এসেছেন। সরকারের এক মাসও পার হয়নি এখন পর্যন্ত। অন্তর্বর্তী সরকার যা যা করতে পারে তার তালিকা দুই ভাগে বিন্যস্ত করা যায়। প্রথমত, বিগত সরকার, তার আগের সরকার এবং তারও আগের সরকারের আমল মিলে যে বিশাল জঞ্জাল স্তূপীকৃত হয়েছে, তা পরিষ্কার করা। সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে, দেশ দুর্নীতিতে ভরে গেছে। এসব দূর করতে হবে।
দ্বিতীয় কাজের মধ্যে আছে, নতুন কিছু গড়ার প্রস্তাব। নতুন একটা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ম্যান্ডেট এই সরকারের আছে কি না, তা নিয়ে একটা বিতর্ক আছে। নির্বাচনের আগে কতটুকু সংস্কার করা যাবে, তাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নির্বাচন ও সংস্কার পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। সংস্কার না করলে নির্বাচন হবে না, আবার নির্বাচন না করলে সংস্কারের কর্তৃত্ব পাওয়া যাবে না। এই দ্বন্দ্ব জীবিত আছে।
এখন তাহলে কোথা থেকে শুরু করতে হবে? শুরু করতে হবে ইতিহাসের দিক থেকে। ঘটনা যা ঘটে গেছে সেখান থেকে। দেশে একটা রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। সেটা জনসমর্থনধন্য। এই অভ্যুত্থানেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী পলায়ন করেছেন এবং জনগণ ছাত্রদের বৈধতা দিয়েছে। এটা নির্বাচনের বিকল্প। এই বিকল্পটা সাময়িক। সময়টা কত দীর্ঘ হবে, তাও জনগণের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। সময়টা আগে থেকে বলে দেওয়া যাচ্ছে না।
জনগণের ইচ্ছা, আগের সরকার যে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে, সেগুলোর ন্যূনতম মেরামত না হওয়া পর্যন্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে না। দুটি বিষয় এখানে বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন ব্যবস্থা পরিপক্ব হওয়ার আগে নির্বাচন অনুষ্ঠান করলে বড় ধরনের ক্ষতি হবে। আবার ব্যবস্থা ঠিক হওয়ার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত নির্বাচন করা না গেলে তার ফল হবে আরো ভয়াবহ। নির্বাচনের জন্য কোনটা যে সঠিক সময়, সেটা মানুষই নির্ধারণ করবে।