অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বেশ কিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে রাহুমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। আর্থিক খাতের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে কমিটি গঠন করেছে। কালোটাকা সাদা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের তিন সপ্তাহ পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে বলা যাবে না। আদালত অঙ্গনে কিছু নিন্দনীয় ঘটনা, আওয়ামী লীগ নেতাদের মালিকানাধীন কারখানায় আগুন ও লুটপাটের ঘটনা জনমনে উদ্বেগ তৈরি করেছে। কারখানার মালিক যত অন্যায়ই করুন না কেন, কারখানা তো দেশের সম্পদ। এসব কারখানায় হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করেন। কারখানা বন্ধ হলে তাঁরা জীবিকা হারাবেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের দমনপীড়নের প্রধান হাতিয়ার ছিল পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন হত্যার ঘটনায় তাঁরা ৫ আগস্টের আগে বিএনপি, জামায়াতের নেতা-কর্মী ও আন্দোলনের সমন্বয়কদের আসামি করেছিলেন। ক্ষমতার পালাবদলের পর সেসব মামলায় তাঁদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক মন্ত্রীদের আসামি করছেন। এ ক্ষেত্রে পুলিশ বাদী তথা নিহত ব্যক্তির স্বজনদের দোহাই দিলেও তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন, মামলা সম্পর্কে তাঁরা কিছু জানেন না। পুলিশ তাঁদের কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নিয়েছেন।
গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান রুখতে আওয়ামী লীগ সরকার যে নজিরবিহীন দমন–পীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তার বিচার হতেই হবে। কিন্তু সেটি হতে হবে তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে। কিন্তু কিছু শিক্ষাবিদ, ইতিহাসবিদ, লেখক, গবেষক, আইনজীবী, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে হত্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। তারা যে সমালোচনা বা বিতর্কের উর্ধ্বে থাকবেন তা নয়। তাঁদের লেখালেখি বা বক্তব্যে কেউ আহত হলে তারও আইনি প্রতিকার আছে। কিন্তু হত্যা মামলা কেন?
হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকা, বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ও সম্পাদকদের বিরুদ্ধেও। কোনো কোনো সাংবাদিককে একাধিক হত্যা মামলায় জড়িয়ে একাধিকবার রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। এটা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
আওয়ামী লীগ আমলে গায়েবি ও ঢালাও মামলার অন্যতম শিকার হয়েছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁর বিরুদ্ধে ময়লায় গাড়ি পোড়ানো থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করার অভিযোগসহ ৮০টিরও বেশি মামলা হয়। এসব মামলার জন্য তাঁকে অনেকবার জেলে যেতে হয়েছে।
বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনিও ঢালাও মামলার প্রতিবাদ করে বলেন, ‘আমি অনুরোধ করব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর কাছে, দল শুধু নয়, সব মানুষের বিরুদ্ধে যে ঢালাও মামলা দেওয়া হচ্ছে এবং যেকোনো মানুষের বিরুদ্ধে শত্রুতা থাকলেই মামলা দেওয়া হচ্ছে, মামলাগুলো নেওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যাতে যাচাই করে নেয় যে কোনটি সম্ভব, কোনটি সম্ভব নয়। প্রাথমিক যে তদন্ত, সেটা করা দরকার। তা না হলে একটু ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলে তার নাম দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি মির্জা ফখরুলের আহ্বান হলো: ‘এমন কোনো মামলা দেবেন না, যে মামলায় কোনো সারবস্তু থাকবে না এবং সব মামলায় কেন্দ্রীয় নেতাদের জড়িত করে মামলা দেওয়া, এটা বোধ হয় সমুচিত নয়।’ একজন দায়িত্বশীল রাজনীতিকের মতোই কথা বলেছেন তিনি। কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বিএনপির প্রতি একটুকু সহানুভূতি দেখালে হয়তো তাঁদের এখন পালিয়ে থাকতে হতো না। রাজনীতির বাইরে যে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক আছে, সেটা ক্ষমতাসীনেরা ভুলে যান।