১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। চিত্রা নদীর মধ্য দিয়ে আমরা ছুটে চলেছি। অনেকেই বলেন, এই নদীর দুই কূল চিত্র বা ছবির মতো সুন্দর বলেই এর নাম হয়েছে চিত্রা। চিত্রা নদীর সঙ্গে কেমন নিবিড়ভাবে এস এম সুলতানের নাম জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে তাঁর স্বপ্নের সেই সব কৃষকের কথা! এক দুপুরে তাঁর সঙ্গে বসে আমি শুনেছিলাম মোজার্টের নবম সিম্ফনি। সেই সিম্ফনির শব্দই যেন সেদিন ভেসে আসছিল আর কানে বাজছিল—বিজ্ঞানের প্রথম পথিকেরা হলেন কৃষক, নাবিক আর তাঁতিদের সন্তান; যাঁরা চাঁদ আর নক্ষত্রের অবস্থান দেখে জীবনের পথ চলতেন, ইজিয়ান সাগরের উপকূল, পাথরের আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ তাঁদের অনুরণিত করত। শুধু চিত্রাই নয়, মধুমতী, সুগন্ধা, ধলেশ্বরী, রূপসা দিয়ে গেলে সেই শব্দ আমিও শুনতে পাই। কেননা, সভ্যতা নির্মাণের মৌলিক শক্তির আঁধার হলো এই সব পেশার মানুষ।
এস এম সুলতানের সঙ্গে আমার দেখা ১৯৮৭ সালে; এটা ঠিক পরিচয় না, একধরনের হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে হাই-হ্যালো বলা। এক দুপুরে জার্মান কালচারাল সেন্টারের লাইব্রেরিতে ঢুকেছি। বই পড়ার পাশাপাশি সেখানে মিউজিক শোনা যেত। লাইব্রেরিয়ান জানতে চাইলে অনুরোধ করলাম মোজার্টের নাইনথ সিম্ফনি বাজাতে। হঠাৎ দেখলাম বড় বড় চুলওয়ালা লম্বাটে ও বহু অভিজ্ঞতার ছাপের মুখের একজন মানুষ বুড়ো আঙুল তুলে এমনভাবে হাসলেন, যাতে মনে হলো তিনি বলছেন, দারুণ বলেছ! জার্মান সংগীত শুরু হলে মনে হলো তিনি ভীষণভাবে উপভোগ করছেন। আমি কিছুক্ষণ পরে লাইব্রেরিয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে এই ভদ্রলোক?’ লাইব্রেরিয়ান দাঁড়িয়ে গেলেন, ‘আপনি এস এম সুলতানকে চেনেন না!’ এই না চেনাটা যেন আমার অপরাধ ছিল।
এস এম সুলতান। সেই বিখ্যাত শিল্পী। সালভাদর দালি, পাবলো পিকাসোর পাশাপাশি সুলতানকে পৃথিবীর মানুষ চেনে, যিনি ভবিষ্যতের কৃষকদের ছবি আঁকতেন। পরবর্তী সময়ে আমি তাঁর আঁকা ছবি দেখেছিলাম মাসখানেক ধরে। কী মনোযোগ দিয়ে কাজ করতেন! বিশাল বিশাল সব ক্যানভাস—পেশিওয়ালা কিষান-কিষানির ছবি, যাঁরা এই মানবসভ্যতার আদি শক্তির আঁধার হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
তাঁর জমি কর্ষণ, ধান কাটা ছবিগুলো দেখলে মনে হয় জীবনকে যাপনের উৎসবে রূপান্তরের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, ছবিতে গ্রামীণ রমণীদের সুডৌল ও সুঠাম গড়নে। নারীর মধ্যে উপস্থিত চিরাচরিত রূপলাবণ্যের সঙ্গে তিনি শক্তির সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। বেঁচে থাকার সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণের স্বতঃস্ফূর্ততা জীবনকে আনন্দযজ্ঞে রূপান্তর করেছিলেন—মাছ ধরা, ধান ঝাড়া, ধান ভাঙা চিত্রগুলো এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তাঁর ছবিগুলোয় গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের শ্রেণিদ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির কিছু ক্রূর বাস্তবতা উঠে এসেছে। এ রকম দুটি বিখ্যাত ছবি হচ্ছে, হত্যাযজ্ঞ এবং চরদখল।
জয়নুল আবেদিনকে সুলতান বলেছিলেন, ‘জয়নুল, তুমি আমার জাতিকে রুগ্ণ-ক্লিষ্ট রূপ দিয়েছ, আমি তাদের মাসলস দেব, ঐশ্বর্য ও শক্তি দেব।’ এস এম সুলতানের এই কথার তাৎপর্য এভাবে বর্ণনা করা যায়: যে শক্তি যুদ্ধ করে, ধ্বংস করে, সেই শক্তি কৃষকদের শ্রমে সভ্যতাকে নির্মাণ করে। এটা আমাকে ২ হাজার ৫০০ বছর আগে গ্রিক বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ অ্যানাক্সিমেন্ডারের কাছে নিয়ে যায়। যিনি লম্বভাবে রাখা একটি লাঠির অপস্রিয়মাণ ছায়ার ওপর নির্ভর করে নিখুঁতভাবে বছরের দৈর্ঘ্য ও বিভিন্ন ঋতুর সময় নির্ণয় করেছিলেন। যুগ যুগ ধরে যে লাঠি অন্যের মাথায় আঘাত করা, বল্লম তৈরি করে মানুষকে বিদ্ধ করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, অ্যানাক্সিমেন্ডার তা সময় পরিমাপে ব্যবহার করেছিলেন। এই প্রাকৃতিক সৌরঘড়ি শুধু সমাজসভ্যতার সময় পরিমাপে সূক্ষ্মতাই আনেনি, তা সমাজকে কৃষিসৃজনেও উদ্দীপনা জুগিয়েছিল, গড়ে উঠেছিল সমাজসভ্যতা।
সুলতান ইতিহাসের সেই অমোঘ সত্যতাটায় আলোড়িত হয়েছেন এই ভেবে, যে কৃষক কৃষিকাজ সভ্যতার মৌলিক ভিত্তিভূমি হিসেবে কাজ করেছেন, সেই কৃষক ক্ষীণকায়, নিষ্পেষিত কেন? তাহলে জীবনের উচ্ছ্বাস কীভাবে বিকশিত হবে, কীভাবে জীবন উন্মোচন হবে? তাই তাঁদের হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতা, বেদনাকে দূরীকরণের স্বপ্ন নিয়ে সুলতান বলেছেন: ‘আমার ছবির ব্যাপার হচ্ছে সিম্বল অব এনার্জি, এই যে মাসলটা, এটা সংগ্রামের কাজে ব্যবহার হচ্ছে, মাটির উর্বরতার জন্য সংগ্রাম। তার বাহুর শক্তিতে লাঙলটা মাটির নিচে যাচ্ছে, ফসল ফলাচ্ছে। আমাদের অঞ্চল হাজার বছর ধরে এই কৃষকের শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। অথচ সেই কৃষকদের হাজার বছর ধরে মারা হয়েছে।’