বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দমন-পীড়নের প্রতিবাদে বিগত সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স না পাঠানোর ঘোষণা দেন। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি দেশে ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রবাসীরা সমাবেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনও করেন। বিক্ষোভের অভিযোগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫৭ বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়ার বিষয়টিরও রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। সবকিছু মিলে রেমিট্যান্স প্রবাহের নিুগতি পরিলক্ষিত হয়। গণমাধ্যম সূত্রমতে, ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স আসে মাত্র ১৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রথম ১৩ দিনে এসেছিল প্রায় ৯৮ কোটি এবং ১৪ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত এসেছে ৫২ কোটি ডলার। এ ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণও কমতে থাকে।
ছাত্র গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে নতুন সরকারকে শক্তিশালী করতে প্রবাসীরা বেশি রেমিট্যান্স পাঠানোর ঘোষণা দেন। দেশ গঠনে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে অনেক প্রবাসী ক্যাম্পেইন শুরু করেন। এর ফলে আবারও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২৪ আগস্ট সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুসারে, চলতি আগস্টের প্রথম ২০ দিনে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১৫৩ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ১১২ কোটি ডলার। সে হিসাবে গত বছরের আগস্টের তুলনায় চলতি আগস্টে প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় ৩৭ শতাংশ। রেমিট্যান্স পাঠাতে মালয়েশিয়া, কুয়েত ও ইতালিসহ বিভিন্ন দেশের এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। মানি এক্সচেঞ্জগুলোর কর্মকর্তাদের ভাষ্য, চলতি সপ্তাহে আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে ইতালিপ্রবাসী বাংলাদেশিরা। গত বছর তারা ১ হাজার ১৬৬ মিলিয়ন ইউরো পাঠালেও এবার সেই রেকর্ড ভঙ্গ হতে চলেছে। ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, এখন পর্যন্ত প্রবাসী আয় আসার যে ধারা, তাতে গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ৭ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় দেশে আসছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি মাসের শেষে তা ২৫০ কোটি ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে। যদি তা হয়, তাহলে চলতি বছরের মধ্যে আগস্ট মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় আসার রেকর্ড হবে।
দেশের সংকটময় অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স বেশি পরিমাণে আসার সংবাদ নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করতে প্রবাসীদের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠানোর এই আগ্রহ ধরে রাখতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে জুনে, যার পরিমাণ ছিল ২৫৫ কোটি ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২২৫ কোটি ডলার আসে মে মাসে এবং সর্বশেষ জুলাইয়ে আসে ১৯১ কোটি ডলার। এ বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন যথাক্রমে ২১০ কোটি, ২১৬ কোটি ৬০ লাখ, ১৯৯ কোটি ৬৮ লাখ এবং ২০৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমটি) তথ্যানুসারে, এখন পর্যন্ত বছরভিত্তিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছিল ২০২১ সালে, যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২০৭ কোটি ডলার। ২০২২ সালে তা কমে হয় ২ হাজার ১২৯ কোটি ডলার এবং ২০২৩ সালে সামান্য বেড়ে তা দাঁড়ায় ২ হাজার ১৯১ কোটি ডলারে।
গত ৭ জুলাই প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ৩৯১ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে, যার পরিমাণ ৪৫৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। তাছাড়া শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় আরও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, ইতালি, কাতার, ওমান ও বাহরাইন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৯৬ কোটি ১৬ লাখ ডলার এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, ইতালি, কাতার, ওমান ও বাহরাইন থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ যথাক্রমে ২৭৯ কোটি ৩২ লাখ, ২৭৪ কোটি ১৫ লাখ, ১৬০ কোটি ৭৭ লাখ, ১৪৯ কোটি ৬৭ লাখ, ১৪৬ কোটি ১৬ লাখ, ১১৫ কোটি, ১১২ কোটি ৩৫ লাখ এবং ৬৩ কোটি ৯২ লাখ ডলার। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল সৌদি আরব থেকে। দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৩৭৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৫২ কোটি ২০ লাখ ডলার এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আসা রেমিট্যান্সের মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ২৬৮ কোটি ৪০ লাখ ৭০ হাজার ডলার। আর বিশেষায়িত ব্যাংকের মাধ্যমে ৭১০ কোটি ৮৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২ হাজার ৪৩ কোটি ৬৫ লাখ ১০ হাজার ডলার এবং বিদেশি খাতের বাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৭ কোটি ৬২ লাখ ১০ হাজার ডলার।
বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে এ অর্থ ব্যয় হয়। রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় ৬৩ শতাংশ দৈনন্দিন খাতে খরচ হওয়ায় পরিবারগুলোর দরিদ্রতা দূর হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যসূত্রে জানা যায়, প্রায় দুই বছর ধরে প্রতিমাসে বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রায় এক লাখ কর্মী বিদেশে যাচ্ছেন। এর উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো সৌদি আরবের সব ফার্মে বাংলাদেশি কর্মীদের কোটা ২৫ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি, চার বছর বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলে যাওয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের গন্তব্যের পাশাপাশি ইতালি ও যুক্তরাজ্যের মতো অপ্রচলিত বাজারগুলোয় জনশক্তি রপ্তানি।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৩ সালে বিশ্বের ১৩৭টি দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৩ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মীর, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে বিদেশে যাওয়ার রেকর্ড। এসব কর্মসংস্থানের বেশিরভাগই হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। এ সময় সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছে সৌদি আরবে। দেশটিতে ১১ মাসে যায় ৪ লাখ ৫১ হাজার ৫০২ কর্মী। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ কর্মী যাওয়া দেশ হচ্ছে মালয়েশিয়া ও ওমান। দেশ দুটিতে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৪৩১ এবং ১ লাখ ২৫ হাজার ৯৬১। তবে জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি সত্ত্বেও এর বিপরীতে বাড়েনি রেমিট্যান্স প্রবাহ। উল্লেখ্য, প্রবাসী আয় অর্জনে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের অন্যতম অনুঘটক হিসাবে বিবেচ্য। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুতসহ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করছেন। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিকালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রবাসী আয়ের ব্যাপক ভূমিকা কারও অজানা নয়। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান উৎস রপ্তানি খাত হলেও রেমিট্যান্সের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি কার্যকর বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাস অর্থাৎ জুলাই থেকে মে পর্যন্ত দেশের রপ্তানি আয় ছিল ৩৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। একই সময় প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিবিদদের মতে, ৩৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের বিপরীতে অন্তত ৩০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে দেশের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রা আয় দাঁড়ায় মাত্র ৬-৭ বিলিয়ন ডলারে। কিন্তু রেমিট্যান্স হিসাবে প্রবাসীরা বিদেশ থেকে যে অর্থ পাঠান, তার বিপরীতে দেশের কোনো ব্যয় নেই। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পুরোটাই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি রিজার্ভ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। তাই প্রবাসীদের জন্য যত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে, দেশে তত রেমিট্যান্স আসবে। আর রেমিট্যান্স প্রবাহ সচল থাকলে তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। কাজেই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।