গত ৩০ বছরে দেশের এত ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়েনি পূর্বাঞ্চলের মানুষ। প্রতিবছরের বন্যা মোকাবিলা করে অভিজ্ঞ দেশের উত্তরের জনপদের তুলনায় তাই তাঁদের কষ্ট–ভোগান্তি অনেক বেশি হচ্ছে। এই বন্যার পানি সামনের কয়েক দিনের মধ্যে নেমে যেতে পারে। তবে সিলেট ও উত্তরাঞ্চলের পর অন্যতম বন্যাপ্রবণ হয়ে ওঠা এই এলাকা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। এই বন্যার কার্যকারণগুলো সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা এবং সামনের দিনের করণীয় ঠিক করা দরকার।
ভৌগোলিক অবস্থান ও নদ-নদী
উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য মূলত পাহাড়ি অঞ্চল, যেখানে ৩ হাজার ফুট পর্যন্ত উঁচু পাহাড় রয়েছে। ত্রিপুরার সীমান্ত ঘেঁষে রয়েছে বাংলাদেশের ৭টি জেলা—উত্তরে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ, পশ্চিমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা, দক্ষিণে ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং পূর্বে খাগড়াছড়ি জেলা অবস্থিত।
ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়গুলো থেকে উৎপন্ন হয়ে বেশ কয়েকটি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ১৫টিই ত্রিপুরা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সেগুলো হলো জুরি, মনু, ধলাই, লংলা, খোয়াই, সুতাং, সোনাই, হাওড়া, বিজনী, সালদা, গোমতী, ডাকাতিয়া, সিলোনিয়া, মুহুরী ও ফেনী।
এর মধ্যে ত্রিপুরা থেকে ছয়টি নদী উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে, ছয়টি নদী পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে এবং তিনটি নদী দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। অর্থাৎ ত্রিপুরা রাজ্যের বৃষ্টির পানি এই ১৫টি নদী দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে প্রবল গতিতে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আর এই বৃষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি হলে তা ত্রিপুরা রাজ্যসহ এর সংলগ্ন বাংলাদেশের সাতটি জেলায় বন্যা সৃষ্টি করতে পারে—যাকে বলা হয় আকস্মিক বন্যা বা ফ্ল্যাশ ফ্লাড।
ত্রিপুরা ছাড়াও সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলের উত্তরে উঁচু উঁচু পাহাড়বেষ্টিত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অতিবৃষ্টির পানিও বাংলাদেশে মাঝেমধ্যেই আকস্মিক বন্যা বা ফ্ল্যাশ ফ্লাড তৈরি করে। গত মে-জুন মাসে সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে কয়েক দফায় ভয়াবহ আকারে আকস্মিক বন্যা হয়েছিল।
ভারত থেকে যে অঞ্চল দিয়েই বন্যার পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করুক না কেন, সেই পানি দেশের প্রধান নদীগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে এই বন্যা দেখা দিলে বঙ্গোপসাগরের অতিমাত্রার জোয়ারের কারণে সেই বন্যার পানি ধীরগতিতে সাগরে নামতে থাকায় বন্যার প্রকোপ বেড়ে যায় এবং বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়।
আবহাওয়া পরিস্থিতি
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বর্ষাকাল মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। রাজ্যটির গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত বাংলাদেশের তুলনায় কিছুটা বেশি। সিলেট-সুনামগঞ্জের উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বৃষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি হলেও সে তুলনায় ত্রিপুরার গড় বৃষ্টির পরিমাণ কম।
কিন্তু আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৯ আগস্ট থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও সংলগ্ন বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে শুরু হয় মেঘ বিস্ফোরণ। পশ্চিম দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস দেশের পূর্বাঞ্চলের আকাশে প্রবেশ করে। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা লঘুচাপ কক্সবাজার-চট্টগ্রাম হয়ে কুমিল্লা-নোয়াখালীর সীমানায় চলে আসে।
আর মৌসুমি বায়ুও এ সময় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই তিনে মিলে বিপুল পরিমাণ মেঘ গোটা অঞ্চলের আকাশে স্তরে স্তরে জমা হয়। একসময় তা বিস্ফোরিত হয়ে প্রবল বর্ষণ তৈরি করে। ত্রিপুরা থেকে আসা ঢল বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলকে বন্যায় বিপর্যস্ত করে ফেলে। এ পরিস্থিতি বিস্তৃত ছিল ত্রিপুরা থেকে কুমিল্লা-ফেনীর ৫০ থেকে ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত।