বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা যখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, তখন তার দলের নেতাকর্মীরা ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। শুধু তাই নয়, যে পুলিশের শক্তিবলে তিনি গত তিনটি টার্ম এ দেশকে শাসন করেছেন, সেই পুলিশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরাও আগে থেকে কিছু জানতেন না। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ভেতর যেমন ক্ষোভ আছে, তেমনই তৎকালীন পুলিশের কর্মকর্তারাও তাদের খেদ প্রকাশ করেছেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ঢাকা ছেড়ে দিল্লি পাড়ি দেওয়ার পরদিনই ভারতের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের ক্ষোভের কথা প্রকাশিত হয়। ৬ আগস্ট আনন্দবাজার লিখেছে, একসঙ্গে এক ছাদের তলায় বসে দেশ শাসন করেছেন। নেত্রীর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। অথচ সেই নেত্রীই দুঃসময়ে দলের সহকর্মীদের বিপদে ফেলে কেবল আত্মীয়দের সঙ্গে নিয়ে দেশ ছাড়লেন। বিন্দুমাত্র আঁচ পেতে দিলেন না সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গীদেরও। আনন্দবাজার পত্রিকার ভাষায়, আওয়ামী লীগ নেতা-মন্ত্রীরা ক্ষোভে ও দুঃখে বলেছেন, ‘আমাদের আগে থেকে জানালে আমরাও নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার সুযোগ পেতাম। দেশ ছেড়ে যদি যাবেনই, তাহলে দলের নেতাকর্মীদের ওই আন্দোলনের মুখোমুখি কেন দাঁড় করালেন?’ কলকাতার বাংলা পত্রিকাটি আরও জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের অন্তত ছয়জন মন্ত্রী ও দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পাঁচজন নেতা নিজেরাই এ কথা জানিয়েছেন, ‘হাসিনার একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত এবং জেদের কারণে দলের নেতাকর্মীরা বিপদে পড়েছেন। দলের নেত্রী হয়েও নিজের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও বাকিদের বিপদে ফেলে তিনি চলে গেলেন।’
অপরদিকে ৩ আগস্ট সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার শিক্ষার্থীদের ওপর সেনাবাহিনী গুলি চালাবে না জানালে শেখ হাসিনা ক্ষিপ্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন, সেনাবাহিনী ছাড়াই পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের পেটুয়াবাহিনী দিয়ে আন্দোলন মোকাবিলা করবেন। শেখ হাসিনার এ সিদ্ধান্ত দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়া হয়। বলা হয়, ওয়ার্ড পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে প্রতিহত করতে হবে। পরদিন ৪ আগস্ট, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ক্যাডাররা পুলিশের ছত্রছায়ায় অস্ত্রশস্ত্র হাতে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিন ছিল বাংলার ইতিহাসে একটি রক্তস্নাত দিন। দেশজুড়ে গণ-আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী আরও শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ভেবেছিলেন হাসিনার নির্দেশে পরদিনও তাদের হয়তো এভাবেই আন্দোলন মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের কিছু না জানিয়ে নিজেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। অহমিকা, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও একরোখা স্বভাবের কারণে শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মাত্রা দেখতে পাননি। ফলে, আন্দোলন দমনে শুরু থেকেই একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন। এ ব্যাপারে দলের অধিকাংশ শীর্ষনেতারা ছিলেন অন্ধকারে। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন গণ-অভ্যুত্থানে মোড় নিচ্ছিল, তখন অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার পরামর্শ দিলেও শেখ হাসিনা কানে তুলেননি। কথিত আছে, এ সময় তিনি তার চার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। তাদের দেখানো পথে হাঁটাতে গিয়ে তিনি সবকিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। এ বিষয়ে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের এক নেতা ভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এ চারজন নেতা হলেন-আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তার নিজপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। এ চার ব্যক্তির ওপর শেখ হাসিনার এতই অন্ধবিশ্বাস ছিল, তিনি অন্য নেতাদের কোনো পরামর্শ শোনাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন, যা তাকে মাঠের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। তিনি বলেছেন, ‘চারজনের এ দলই শেখ হাসিনার পতন ডেকে এনেছে।’ ‘আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মতো পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও শেখ হাসিনার এরূপ আচরণে বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি যে দেশত্যাগ করছেন, কেউ তাদের বলেননি। টেলিভিশনে তার দেশ ছেড়ে যাওয়ার খবর জেনেছেন। শেখ হাসিনার হেলিকপ্টার যখন গণভবন থেকে আকাশে উড়েছে, তখন পুলিশের আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনারসহ অন্য জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তারা বিস্ময়ে শুধু তাকিয়ে দেখেছেন। এ সময় তাদের ক্ষোভের সঙ্গে বলতে শোনা গেছে, ‘তিনি তো আমাদের বলে যেতে পারতেন। অথচ আমরা তার শেষ নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’
শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন আজ তিন সপ্তাহ হয়েছে। কিন্তু তিনি কোন ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাসে সেখানে আছেন, ভারত এ পর্যন্ত কোনো তথ্যই প্রকাশ করেনি। এতদিন তারা বলে এসেছেন, শেখ হাসিনা যেহেতু ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্টধারী, এ কারণে ২০১৮ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘ট্রাভেল অ্যারেন্জমেন্ট’-এর ১(এ) ধারা অনুযায়ী তিনি ৪৫ দিন ভিসা ছাড়াই ভারতে থাকতে পারবেন; কিন্তু বাংলাদেশ সরকার, ২১ আগস্ট কূটনৈতিক দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন এমন ব্যক্তি ব্যতীত সবার ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট বাতিল করে দেয়। সে হিসাবে শেখ হাসিনার ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টও বাতিল হয়ে যায়। অতএব, বৈধ উপায়ে তার ভারতে থাকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পাসপোর্ট বাতিলের পাঁচদিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ভারত সরকার শেখ হাসিনার বর্তমান ‘ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস’ কী, এ নিয়ে কিছু বলেনি। তবে যে কোনো উপায়ে হোক শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিতে ভারত নিশ্চয়ই বিকল্প কোনো না কোনো পথ খোলা রেখেছে। এর আগে গত ১৬ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সাংবাদিকদের ব্রিফি করার সময় এক সাংবাদিক যখন তাকে প্রশ্ন করেন, ‘৪৫ দিনের মধ্যে যদি শেখ হাসিনার বর্তমান পাসপোর্ট বাতিল করা হয়, তাহলে ভারতের কী করণীয় আছে’? উত্তরে জয়সওয়াল বলেছিলেন, সেটাও বড় কোনো সমস্যা নয়। কারণ এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের ‘প্ল্যান বি’ বা ‘প্ল্যান সি’ প্রস্তুত রাখতেই হয়। এখানেও নিশ্চয়ই সেটা তৈরি আছে। ভারতের এ ‘প্ল্যান বি’ অথবা ‘প্ল্যান সি’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তা না জানা পর্যন্ত প্রশ্ন থেকেই যাবে, শেখ হাসিনা বর্তমানে কোন শর্তে সে দেশে অবস্থান করছেন। তিনি কি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন? নাকি তাকে অন্তরিন অবস্থায় রাখা হয়েছে? ভারত বর্তমানে কোন নৈতিকবলে শেখ হাসিনাকে সে দেশে রেখে দিয়েছে? ভারত নিশ্চয়ই জানে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ত্রিশেরও অধিক হত্যা মামলার আসামি। বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে স্বাভাবিক কারণেই জানতে ইচ্ছে করে, একাধিক হত্যা মামলার ভিনদেশি আসামিকে এভাবে আশ্রয় দেওয়া কি ভারতের সংবিধান অনুমোদন করে?
শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত এ মুহূর্তে কিছুটা বেকায়দায় আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত যে বন্ধুরাষ্ট্র হারাচ্ছে, তা নিয়ে ভারত কম উদ্বিগ্ন নয়। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অবস্থাও ভারতের জন্য সুখকর নয়। বাংলাদেশ ও তার জনগণের প্রতি ভারতের এতদিনের আচরণ যে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরিতে সাহায্য করেছে, এখন হয়তো তারা টের পাচ্ছে। বাংলাদেশিদের এ মনোভাব একদিনে তৈরি হয়নি। এ দেশের নাগরিকদের অবমূল্যায়নই এর জন্য দায়ী বলা যায়। বাংলাদেশ ও তার জনগণের সঙ্গে ভারত ভালো সম্পর্ক গড়ে না তুললেও শেখ হাসিনা ও তার দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল দৃঢ়। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য ভারত এমন কোনো কাজ নেই যে করেনি। গত এক দশকেরও বেশি সময় শেখ হাসিনার এ অগণতান্ত্রিক সরকারকেই অন্ধের মতো তারা সাপোর্ট দিয়ে গেছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে মুখে মুখে বাংলাদেশকে ‘বিশ্বস্ত প্রতিবেশী’ ও ‘পরম বন্ধু’ দেশ বলে একতরফা শুধু সুবিধাই নিয়ে গেছে তারা। কাজেই আজ এ চরম দুঃসময়ে ভারত যে শেখ হাসিনার পাশেই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে একের পর এক হত্যা মামলা হচ্ছে, তাতে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কি ভারতকে অনুরোধ করবে? এর উত্তরও পাওয়া গেছে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সম্প্রতি দেওয়া এক বক্তব্যে। ১৫ আগস্ট রয়টার বার্তা সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে ভারতকে অনুরোধ করবে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ বন্দিবিনিময় চুক্তি অনুযায়ী এ অনুরোধ করা হবে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও যোগ করেন, ভারত সরকারের জন্য হয়তো এটি একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করবে। সত্যিই কি তাই? ভারত কি সত্যিই বিব্রত হবে? এ বিষয়ে রয়টার্স, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে তারা রাজি হননি। তবে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ‘র’-এর এক সাবেক কর্মকর্তা এ বিষয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কাছে যে মন্তব্য করেছেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার মধ্যেই কি আমাদের স্বার্থ নিহিত আছে? না, বিষয়টি এমন নয়। কেবল বন্দিবিনিময় চুক্তির বৈধতা কোনো ব্যাপার নয়।’ এরপর তিনি যা বলেছেন, তা আরও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে অনেক মানুষ রয়েছে, যারা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। যারা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে মূল্য দেয়। তাই বাংলাদেশে আমাদের একটি শক্তিশালী পক্ষ রয়েছে। এ সম্পর্কের দিকনির্দেশনা নিয়ে আমাদের এখনো উপসংহারে আসা হয়নি।’ ভারতের আরও একজন কর্মকর্তা, যিনি প্রতিরক্ষা বিভাগে কাজ করেন, তিনি একই সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘কোনো দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে বন্দিবিনিময় করে না। এটি চুক্তি থাক বা না থাক।’