একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ভরসাস্থল। তার কাছ থেকেই অনুপ্রেরণা নেন শিক্ষার্থীরা। অতীতে শিক্ষার্থীবান্ধব এমন বহু শিক্ষকের পদচারণায় ক্যাম্পাসগুলো মুখরিত থাকলেও বর্তমানে তা অপ্রতুল। যেকোনো প্রয়োজন, ন্যায্যতার দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামে যে গুটিকয়েক শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের পক্ষে ঢাল হিসেবে অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান অন্যতম।
ছাত্র-জনতার 'জুলাই অভ্যুত্থান' তথা সরকার পতনের আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম মুখ ছিলেন তিনি। প্ল্যাটফর্মটির হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ এবং সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রেও তার ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংকট-সমস্যা, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ-প্রতিবেশ ও রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে সবসময় সোচ্চার এই শিক্ষকের সঙ্গে সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়। তার সঙ্গে আলাপে উঠে এসেছে জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, রাষ্ট্র সংস্কার ও অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয়সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তিত পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক।
দ্য ডেইলি স্টার: ছাত্র-জনতার এ আন্দোলন কেন ইতিহাসের পাতায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে? আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: আমার মনে হয় এ আন্দোলনকে সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার সুযোগ নেই। এর প্রেক্ষাপট নতুন, নিরাপদ সড়ক থেকে কোটা সংস্কার থেকে রাষ্ট্র মেরামত আন্দোলনের রূপ একটু অন্যভাবে বিবেচনা করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে আমরা সবসময় নিপীড়িত শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম। ২০১৮ সালে আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আন্দোলনের একপর্যায়ে যখন শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত হতে শুরু করলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের পাশে দাঁড়ায়।
এই আন্দোলনটি অন্যান্য আন্দোলন থেকে ব্যতিক্রম এই অর্থে যে এটা কোনো শীর্ষ নেতৃত্বকে ঘিরে বিকশিত হয়নি। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে এটি হয়নি। একটি ডিসেন্ট্রালাইজড লিডারশিপের মাধ্যমে সব মতামতের, মতাদর্শের—সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে, এমনকি অনেক ছাত্রলীগকর্মীও এর সঙ্গে যুক্ত হয়।
আন্দোলনটি শুরুতে একেবারেই কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল এবং শান্তিপূর্ণ ছিল। এর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল সমন্বয়ক, যারা একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই শুরু করেছিল। তাদের ভিন্ন মতাদর্শিক পরিচয় থাকতে পারে। কিন্তু তার বাইরে এসে রাজনৈতিক ফোর্স, ব্যানার না থাকায় এই প্লাটফর্ম সবার জন্য একটি স্পেস তৈরি করেছিল, যেটি কোনো রাজনৈতিক দল তৈরি করতে পারছিল না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ছিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা। আর এর সঙ্গে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ঘিরে আগেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব হয়েছে, পরে সেটা অনেক বিস্তৃত হয়েছে। ফলে এ আন্দোলন দমানোর জন্য যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার প্রচণ্ড আগ্রাসী হলো, ছাত্রলীগ-যুবলীগকে ব্যবহার করা হলো, তখন ওই বন্ধন বা সলিডারিটির অংশ হিসেবে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরাও রাস্তায় নেমে এসেছে, যেটি ছিল হিসাবের বাইরে। আমি নিশ্চিত যে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা বা সরকার—কেউই এ হিসাবটি করেনি। কারণ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের কোটা সংস্কার, কিংবা সরকারি চাকরি নিয়ে আগ্রহ তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু তাদের সলিডারিটি বা বন্ধুত্ব সেটি অন্যতম একটি প্রেক্ষাপট। অতীতে তাদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা এই রেজিস্টেন্স তৈরি করেছে।
আবার যখন ছয় সমন্বয়কদের তুলে নিল ডিবি, ভাবা হলো আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেল সহ-সমন্বয়করা নিজেদের মতো করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ডিবি অফিস থেকে যখন আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা দেওয়ানো হলো, তখন তার বিপরীতে অন্যরা চলে এলো নয় দফা দাবি নিয়ে।
অন্যদিকে ঘরের ভেতরেও যখন শিশুসহ অনেকে গুলিবিদ্ধ হলো, মারা গেল, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হলো—তখন প্রতিটি মানুষ নিজেকে অনিরাপদ ভাবতে শুরু করল। এরপর হেলিকপ্টার ব্যবহার করে ব্লকরেইড দেওয়া, এত নৃশংসতা—এসব ভাবনা সবার মধ্যে সেন্স অব ইউনিটি তৈরি করল। সবাই ভাবল এ রেজিম সরাতে না পারলে আমরা কেউই নিরাপদ না এবং সবকিছু মিলিয়ে আন্দোলনটি চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছালো। যার ফলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং শ্রমজীবী—সবাই এক কাতারে চলে আসে। আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দেখলাম ডিওএইচএসে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্ম হলেন।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে ট্যাগিংয়ের রাজনীতি—মানে কেউ যদি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলে তাকে বিএনপি-জামায়াত বলা, আবার কেউ যদি বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলে তাকে আওয়ামী লীগ বলার চর্চা এখানে ছিল। কিন্তু এ আন্দোলনের কোনো রাজনৈতিক পরিচিতি না থাকায় সেন্স অব ইউনিটি তৈরিতে ট্যাগিংয়ের ওই রাজনীতিকে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি।
৫৩ বছরের যে জঞ্জালের রাজনীতি, যা সব মানুষের স্বার্থ রক্ষা না করে গুটিকয় মানুষের স্বার্থ দেখে, ওই রাজনৈতিক কাঠামোতে মানুষ আর ফিরে যেতে চায় না। অন্তত আমি মনে করি মূল ধারার দলগুলোর কর্মী ছাড়া সবাই এর থেকে বেরিয়ে আসতে চায় এবং আমরাও মনে করছি এটিই মোক্ষম সময় পেছনের এ জঞ্জালে ফিরে না যাওয়ার। স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের দ্বিতীয় পর্ব তৈরি হয়েছে।
ডেইলি স্টার: আন্দোলনে শিক্ষক নেটওয়ার্কের একটা ভূমিকা ছিল। রাষ্ট্র গঠনে বা সংস্কারে তাদের করণীয় কী হবে?
তানজীমউদ্দিন খান: আমরা যেহেতু অ্যাকাডেমিক, আমাদের মূল জায়গাটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাব্যবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা আমরা যেরকম চাই, সেরকম দেখতে চাইলে বলতে হবে রাষ্ট্র সংস্কার ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থা বা আমরা যে আকাঙ্ক্ষার কথা বলি সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব না। এ কারণে শিক্ষক নেটওয়ার্কের যে কাজগুলো আমরা করে এসেছি তা আমরা ধারাবাহিকভাবেই করব।
রাষ্ট্র আগে যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থায় আর দেখতে চাই না। এখন যদি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে, আমরা শিক্ষক নেটওয়ার্ক প্রস্তুত তা করার জন্য।