স্বৈরাচার হটাতে না-হটাতেই বাংলাদেশ বন্যার বিপদে পড়েছে। এসবই যেন বাংলার অবধারিত নিয়তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নোয়াখালী-কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতিও দেখছি আমরা। পাশাপাশি ভারতের দিক থেকে ধেয়ে আসা বন্যার পানি নিয়ে স্থানীয়ভাবে তীব্র ক্ষোভ চলছে।
কিন্তু এসব কি আমরা বছর-বছর দেখতেই থাকব? চলতি ক্ষোভ-বিক্ষোভেরই বা পরিণতি কী? দক্ষিণ এশিয়ার পানি-সংঘাতের পুরো পটভূমি জানা-বোঝা না থাকলে এ রকম ক্ষোভ-বিক্ষোভ থেকে পানিপ্রশ্নে ন্যায়সংগত একটা সমাধানের দিকে এগোতে পারতাম না আমরা।
‘দক্ষিণ এশিয়া’ বলতে বর্তমান আলোচনায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তানকে নিয়ে গঠিত এলাকাকে বোঝানো হচ্ছে। বিশ্বের জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ এই অঞ্চলে বাস করে। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার অনেকগুলো দক্ষিণ এশিয়াতেই আছে।
কেবল ঘনবসতি হিসেবেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ পরিচিতি তার দারিদ্র্যের কারণেও। বিশ্বের দরিদ্র জনগণের এক-চতুর্থাংশের বাস এ অঞ্চলেই। এই পুরো অঞ্চলের মধ্যে অনেক সাংস্কৃতিক ঐক্য থাকলেও দেশগুলোর মধ্যে আন্তবাণিজ্য বিশ্বের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে কম—দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় এই হার ২০ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তবাণিজ্য কম হওয়ার প্রধান রাজনৈতিক কারণ—তাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস খুবই দুর্বল। স্বাভাবিকভাবেই এর ছাপ পড়েছে পানির মতো জরুরি প্রসঙ্গেও। পানিও ক্রমে এখানে বিবাদের বিষয় হয়ে উঠছে। কখনো খরায়, কখনো বন্যায় পারস্পরিক ক্ষোভ-বিক্ষোভে থাকতে হয় তাদের।
দক্ষিণ এশিয়ায় পানির চাহিদা ও জোগানেও ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ দেশের পানিকেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদী মানসিকতাও রূঢ় রূপ নিচ্ছে। ফলে অনেক অঞ্চলে পানিতে ধীরে ধীরে মানুষের অভিগম্যতা কমে আসছে। মোদিজির এ রকম কথা হয়তো অনেকের স্মরণ আছে: ‘rakt aur paani ek saath nahin beh sakta.’ এ রকম ঘোষণা পানিযুদ্ধ বাড়ার কথাই জানায়।
জীবনের জন্য পানি জরুরি। দক্ষিণ এশিয়ায় এটা বিশেষভাবে জরুরি। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠেরই পেশা কৃষিকাজ, মাছ ধরা ইত্যাদি। পানির সঙ্গে এখানে তাই জড়িয়ে আছে মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন। যে কারণে ইতিমধ্যে পানি এখানে ‘নিরাপত্তা ইস্যু’ হয়ে উঠছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় পানির প্রধান উৎস তিনটি:
ক. হিমালয় ও সংলগ্ন এলাকা থেকে বয়ে আসা নদীর পানি; বরফ গলা পানি। প্রায় ২০টি আন্তর্জাতিক নদী বয়ে চলেছে দক্ষিণ এশিয়া দিয়ে।
খ. বৃষ্টিপাতের পানি।
গ. ভূগর্ভস্থ পানি।
এ রকম সব উৎস নিয়েই কমবেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ ঘটেছে। দক্ষিণ এশিয়ার নদীগুলোয় এ মুহূর্তে পানি প্রাপ্তির পরিমাণ কমবেশি ৩ হাজার মিলিয়ন একর ফুট। এর বিরাট অংশই প্রবাহিত ভারতের ওপর দিয়ে। এদিকের দেশগুলোর মধ্যে তার আয়তনই সবচেয়ে বড় ৩১ লাখ ৬৬ হাজার ৪১৪ বর্গকিলোমিটার। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এই প্রবাহে কমবেশি হতে পারে। সেই বিপদের ছাপও সিংহভাগই পড়বে ভারতেই। তবে বাংলাদেশে সেই সংকটের তাপ ও ছাপ পড়বে।
পানির দ্বিতীয় উৎস হিসেবে বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া সৌভাগ্যবান। বছরজুড়ে এই অঞ্চলে গড়ে ১ হাজার ১৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় বাংলাদেশে। কিন্তু বৃষ্টিপাতের এই পানি ধরে রাখার পর্যাপ্ত কোনো অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি।