৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের একটি প্রয়াস চলছে। এ প্রয়াসে যুক্ত হয়েছেন সাধারণ ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে জনগণ ও বিভিন্ন চিন্তকবর্গ (থিংকট্যাংক)। তারা রাষ্ট্র সংস্কারের উপায় বের করতে আলোচনা, বাহাস ও সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন, যার উদ্দেশ্য হলো একটি বৈষম্যহীন আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণ। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অনেক প্রতিষ্ঠান সংস্কারে হাত দিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান সংস্কার আর রাষ্ট্র সংস্কার এক কথা নয়। কাজেই এমনভাবে রাষ্ট্রের সংস্কার করা প্রয়োজন, যেন সংস্কার টেকসই হয়। সেজন্য জানা প্রয়োজন-রাষ্ট্র হলো বহু স্তরবিন্যস্ত প্রতিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত ক্ষমতাসীন শক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়ার সমন্বিত বন্দোবস্তবিশেষ। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিদ্যালয়, ব্যাংক, হাসপাতাল, জেলা প্রশাসন ইত্যাদি সরকার প্রতিষ্ঠিত কিছু প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক (যেমন: পরিবার, বাজার), আধা-আনুষ্ঠানিক (যেমন: পাঠাগার ও ইমাম সমিতি) প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের কোনো কর্তৃত্ব থাকে না। কিন্তু রাজনৈতিক দলের সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত সরকারের সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু টেকসই রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সংস্কার সাধন করতে হবে, যেন সব প্রতিষ্ঠানের উত্তরোত্তর স্বয়ংক্রিয় সংস্কার সম্পন্ন হয়।
আমরা জানি, রাজনৈতিক ক্ষমতা গড়ে ওঠে রাষ্ট্রীয়, আধারাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর ভর করে। এ রাজনৈতিক ক্ষমতা হলো রাষ্ট্রজুড়ে বিদ্যমান সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সব নিয়ন্ত্রণকারী, স্বার্থবাদী ও চাপ প্রয়োগকারী অংশীজনের সঙ্গে অলিখিত বন্দোবস্তবিশেষ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠী বিদ্যমান রেওয়াজ, নিয়ম ও আইনকানুন ভেঙে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থনৈতিক বা অন্যান্য সুযোগ লাভে প্রয়াসী হয়। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার অনুরূপ বন্দোবস্তের মাধ্যমে দেশজুড়ে ক্ষমতার বলয় বিস্তৃত করেছিল। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বিএনপি সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েও অনুরূপ ক্ষমতার বলয় বিস্তৃত করেছিল। কিন্তু গত দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন কমিশনসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করে ক্ষমতার বলয় বিস্তৃতি ঘটিয়েছিল। এর মাধ্যমে তারা ফ্যাসিবাদী ও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাছাড়া গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বিকাশের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সমর্থনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশজুড়ে বিস্তৃত এ ক্ষমতার বলয় ভাঙতে সচেষ্ট। তাদের দ্বারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কথাও শোনা যাচ্ছে। তাদের প্রয়াস থেকে এটাও লক্ষণীয়, এ সংস্কারের অংশ হিসাবে তারা সৎ, আদর্শবান, ন্যায়পরায়ণ ও ধর্মভীরু নেতৃত্ব সৃষ্টি করে তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চান। কিছু ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে এ সরকার গত ১৮ আগস্ট স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ-২০২৪ জারি করেছে। কিন্তু টেকসই রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে তা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়ই করতে হবে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র সংস্কারের কথা রাজনীতি বিজ্ঞানে বিবৃত রয়েছে। লক্ষ্য যদি থাকে টেকসই রাষ্ট্র সংস্কার, তাহলে রাজনীতি বিজ্ঞানের দর্শন, তত্ত্ব ও সূত্র মেনে নিয়ে জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার করতে হবে। প্রস্তাবিত এ রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে সরকারের ধরন হবে রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রতিনিধিত্বশীল সংসদীয় সরকারব্যবস্থা। এ সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার পারস্পরিক তদারকি ও ভারসাম্য নিশ্চিত হবে। সেজন্য কিছু নির্বাহী ক্ষমতা প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, জেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে আনুপাতিক হারে বণ্টন ও বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এ বণ্টন ও বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিরক্ষা, নির্বাচন ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের দায়িত্ব, স্বায়ত্তশাসিত জেলা সরকারের কাছে পুলিশ প্রশাসন, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা প্রশাসন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি বিভাগের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব এবং উপজেলা সরকারের কাছে উপজেলাধীন প্রশাসনের ক্ষমতা ন্যস্ত করা যেতে পারে। এভাবে কিছু ক্ষমতার বণ্টন ও বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হবে।
আমরা জানি, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা আইনসভা তথা জাতীয় সংসদেরও সদস্য। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন পদ্ধতিতে ত্রুটির কারণে প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ গড়ে উঠতে পারে না। সেজন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারে জাতীয় সংসদ কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। উল্লেখ্য, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে রাষ্ট্রের সব অংশীজনের অবিরাম দ্বন্দ্ব, বাহাস ও সংলাপ চলতে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সর্বদাই রাজনৈতিক দর্শন, তত্ত্ব ও সূত্র সম্পর্কে চর্চা চলে। তাছাড়া তাদের রয়েছে অনুসারী বিদ্যোৎসাহী চিন্তকবর্গ। এসব দলের মধ্যে রয়েছে জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, জাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরাম ইত্যাদি। যেহেতু নির্বাচন পদ্ধতির ত্রুটির কারণে জাতীয় সংসদে এসব আদর্শবাদী দলের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ থাকে না, সেহেতু এমন একটি নির্বাচনব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন, যেখানে জাতীয় সংসদে ছোট-বড় সব মতাদর্শসম্পন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। সেজন্য এক নির্বাচনি অঞ্চল, এক প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন পদ্ধতি-এ দ্বিবিধ নির্বাচন পদ্ধতির সমন্বয়ে মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতির প্রচলন করা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত এ মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতির প্রথম ও দ্বিতীয় পদ্ধতিতে যথাক্রমে ৩০০ জন করে মোট ৬০০ জন জাতীয় সংসদ প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থাকবে।