‘দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গেছে’। দেশ শুধু দুর্নীতিতে ছেয়েই যায়নি, দুর্নীতি এখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। কেবল আর্থিক দুর্নীতি নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিও সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের কোনো অঙ্গই বুদ্ধিবৃত্তিক ও আর্থিক দুর্নীতির থাবার বাইরে নেই। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে রাষ্ট্রীয়ভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির অবাধ চর্চা। এ বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিই আর্থিক দুর্নীতিকে সর্বগ্রাসী করে তুলেছে।
দুর্নীতিবিরোধী অভিযান দিয়ে অতীতের মতোই চমক দেওয়া যাবে; কিন্তু কার্যকরভাবে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব হবে না। দুর্নীতির ভয়াল থাবা থেকে দেশকেও রক্ষা করা যাবে না। কার্যকর ও টেকসই দুর্নীতি দমনের জন্য প্রয়োজন প্রশাসনিক ও আইনি সংস্কার এবং এ সংস্কার হতে হবে টেকসই। কারণ দুর্নীতি সহায়ক আইন ও বিধিবিধান বহাল রেখে শুধু ব্যক্তি পরিবর্তনের দ্বারা দুদক আইনের মতো দুর্বল ও ক্রটিপূর্ণ আইন দিয়ে কার্যকরভাবে টেকসই দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়।
বিগত সময়ে দুর্নীতি সহায়ক বেশকিছু আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-ত্রুটিপূর্ণ সরকারি চাকরি আইন এবং শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা। সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী দুর্নীতির অপরাধে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করলেও কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরি যাবে না। কারাদণ্ড ভোগ শেষে স্বপদে পুনরায় বহাল হবে। এক্ষেত্রে বিভাগীয় মামলায় শুধু লঘুদণ্ড দেওয়া যাবে, চাকরিচ্যুত করা যাবে না। এ ছাড়াও দুর্নীতিতে অর্জিত সব সম্পদ জব্দ করা হলে বা কোটি টাকা জরিমানা দণ্ড হলেও চাকরি যাবে না। এক্ষেত্রেও বিভাগীয় মামলায় শুধু লঘুদণ্ড দেওয়া যাবে। সত্যি কী আজব ব্যবস্থা! এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগকারী কর্মচারী পুনরায় চাকরিতে বহাল হয়ে আবারও অবাধে দুর্নীতি করার সুযোগ পাবেন। জব্দ হওয়া সম্পত্তির চেয়েও অধিক সম্পত্তি দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জনের সুযোগ পাবেন। জরিমানা দণ্ডের টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জনেরও সুযোগ পাবেন। এরূপ আইন বহাল রেখে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের দ্বারা কীভাবে দুর্নীতি দমন সম্ভব হবে?
পৃথিবীর সব সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশেই দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণের পর কোনো কর্মচারীকে চাকরিতে বহাল রাখার আইনি সুযোগ নেই। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুযায়ী ওই কর্মচারীকে চাকরিতে বহাল রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে। এমনকি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মচারীর ওপর ‘তিরস্কার দণ্ড’র মতো অতি নমনীয় দণ্ড আরোপেরও সুযোগ রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণের পরও কতিপয় কর্মচারীকে চাকরিতে বহাল রেখে লঘু দণ্ড আরোপ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সমালোচনাও হয়েছে। এরূপ বিধান বহাল রেখে কীভাবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের দ্বারা দুর্নীতি দমন সম্ভব হবে? এছাড়াও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারি কোম্পানি গঠনসংক্রান্ত অধিকাংশ আইন ও বিধিবিধানে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আর্থিক দুর্নীতির অবাধ সুযোগ রাখা হয়েছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আইন ও বিধিবিধানের একই রকম অবস্থা।