শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের পর নানা খাতে সংস্কারের প্রসঙ্গ বড় করেই আলোচনায় আসছে। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াদি আছে। ব্যাংক খাতে গত ১৫ বছরে যে লুটপাট হয়েছে তা নিয়ে অনেক কথাই হচ্ছে। তবে একই সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে আরও অনেক ক্ষেত্র। এর একচি হল পুঁজিবাজার।
সত্যি বলতে কি বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার ভেতরে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে শেয়ারবাজার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজার নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হচ্ছে না। ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি এসব নিয়ে অনেক কথা সামনে আসছে, কিন্তু পুঁজিবাজার নিয়ে আলোচনা খুব কম। দেশের দুটি শেয়ারবাজার অনেকদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে পারেনি। বড় কোনো বিনিয়োগের জন্য এর উপর নির্ভর করাও সম্ভব হয়নি। আমাদের দেশের শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়। অথচ পৃথিবীর উন্নত দেশের মানুষ শেয়ারবাজারের কাছে যায় সেখান থেকে বিনিয়োগ নিয়ে আসার জন্য।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে অনেকদিন থেকেই উত্থান-পতন চলছে। আসলে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। ১০ বছর আগে শেয়ারবাজারে যে সংকট তৈরি হয়েছিলো সেখান থেকে এখনো বের হওয়া সম্ভব হয়নি। যদি ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের দিকে লক্ষ্য করা যায় তাহলে দেখা যায়, প্রতিবারেই শেয়ারবাজারে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের কোনো বিচার হয়নি।
তারা বাজার থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। একটি হিসাবে বলা হয়েছে ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালের ঘটনায় প্রায় ৫০ বিলিয়নের মতো ক্ষতি হয়েছিলো শেয়ারবাজারে। এরপর থেকে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। মানুষ এখন পর্যন্ত শেয়ারবাজারে আর আস্থা রাখতে পারে না।
কিছুটা অন্য সমস্যাও আছে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে যারা বিনিয়োগ করেন তারা এটিকে দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগ হিসেবে দেখেন না। তাদের ভাবনা হচ্ছে ডেইলি ট্রেডিংয়ের মতো। তারা শেয়ারবাজারে যাবেন, বিনিয়োগ থেকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অর্থ নগদ বাবদ নিয়ে আসবেন এবং যেটা কমেছে সেটি দিয়ে নতুন কিছু কিনবেন। ডেইলি ট্রেডিং বানিয়ে ফেলাটা শেয়ারবাজারের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার জন্য এটি একটি বড় বাজার বা দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগের জায়গা হতে পারছে না। সবাই স্বল্পমেয়াদী ট্রেডার, দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেই। ফলে বাজার নিম্নমুখী হলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা একধরনের আতঙ্কের মধ্যে পড়ে যায়।
তারা বিনিয়োগ করে ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে। ব্রোকারেজ হাউজ কেনা-বেচা দুই দিক থেকেই কমিশন পায়। তাদের কোনো লস হয় না। শেয়ারবাজারটিকে প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় কেন নিয়ে আসা যাচ্ছে না এটি একটি বড় প্রশ্ন। যারা এখানে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে কারসাজি করলো, তাদের কেন বিচার হলো না এগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আছে।
বর্তমান সময়ে যখন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নিয়ে আলোচনা করি আমরা সেখানে শেয়ারবাজার নিয়ে কোনো আলোচনা বা বড় চিন্তাভাবনা দেখতে পাই না। আমাদের সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন আছে। সেটি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে অধ্যাপক শিবলিরুবায়তের নেতৃত্বে এই কমিশন বাজারের সংস্কার, বাজারে ভালো মানের শেয়ার ফিরিয়ে আনা এসব ব্যাপারে কোনো বড় ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। তারা বিদেশে কতোগুলো লোক-লস্কর নিয়ে গিয়ে রোড শো করেছে, অনেক টাকা খরচ করেছে, কিন্তু বাজারে গতি আনতে পারেনি। যে রোড-শোগুলো চেয়ারম্যান করলেন সেগুলোর ফলাফল নিয়ে কোনো জবাবদিহিতাও ছিল না।